‘মিতিনমাসি সমগ্র ১’ বইয়ের ভূমিকাঃ আমি যে কখনও গোয়েন্দা কিংবা রহস্য গল্প লিখব, এমনটা ভাবিইনি। তবে হ্যাঁ, পাঠক হিসেবে গোয়েন্দা কাহিনি। কিন্তু আমাকে টানত খুব। সেই ছেলেবেলা থেকেই। ব্যোমকেশ বক্সি, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, এমনকী ঘনাদার তুখোড় রহস্য-সন্ধানী রূপটা আমায় দারুণ রোমাঞ্চিত করেছে তখন। গোয়েন্দার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পেছন পেছন আমার মগজও যে প্রাণপণ ছুটত, এ তো স্বীকার করতেই হবে। তবে একথাও ঠিক, একটা প্রশ্নও তখন থেকেই উঁকিঝুঁকি দিত মনে। এত যে সব বিখ্যাত বিখ্যাত গোয়েন্দা, সকলেই পুরুষ কেন? আগাথা ক্রিস্টির মতো দুঁদে গোয়েন্দালেখক নিজে মহিলা হয়েও, মিস মাৰ্পলের কয়েকটি কাহিনি ছাড়া, কেন একজন পুরুষকেই বেছেছেন তাঁর গোয়েন্দা চরিত্রে? তবে কি লেখক এবং পাঠক-পাঠিকারা নিজেদের অজান্তেই ধরে নিয়েছেন, গোয়েন্দা হওয়ার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি মেয়েদের নেই? ক্রিমিনালদের কবজা করতে একজন গোয়েন্দাকে নানানরকম বিপদ আপদেও পড়তে হয়। মেয়েরা কি ওই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যোগ্য নন? গোয়েন্দা মানে কি তবে শুধুই হি-ম্যান? বুদ্ধিদীপ্ত ম্যাচো ইমেজ কি ছেলেদেরই একচেটিয়া সম্পত্তি? এই মধ্যযুগীয় ধারণা হঠাতেই আমার গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা তথা মিতিনের আবির্ভাব। কিশোর-কিশোরীদের কাছে যে মিতিনমাসি। আমি মিতিনকে সৃষ্টিছাড়া বীরাঙ্গনা রূপে আঁকতে চাইনি, বরং আজকালকার দিনের একজন শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী সাহসী অথচ ঘরোয়া গৃহবধূ হিসেবেই সৃষ্টি করেছি সাধ্যমতো। যে কিনা ছেলেকে হোমটাস্কও করায়, প্রয়োজনে রান্নাবান্নাও করে, আবার ব্যাগে রিভলভার পুরে খুনে-বদমাশদের সে ধাওয়াও করে অনায়াসে। এবং রহস্য উন্মোচন তার পেশা তো বটেই, নেশাও। আরও একটা চেষ্টা করেছি। সচেতনভাবে। মিতিনমাসির রহস্য কাহিনি…
সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আত্মপ্রকাশ করা একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বই সমূহ পাঠকদের প্রবলভাবে টানতে পেরেছে সমসাময়িক মধ্যবিত্ত শহুরে জীবনের টানাপোড়েন, পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ আর নৈতিক অবক্ষয়কে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। সেই সাথে নারীর জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, অনুভূতিগুলোও ছিলো সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর বই সমগ্র’র আরেক উপজীব্য বিষয়। সুচিত্রা ভট্টাচার্য ১৯৫০ সালের ১০ই জানুয়ারি বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও লেখিকার বাবার বাড়ি ছিলো মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। কিন্তু লেখিকার স্কুল ও কলেজ জীবনের পুরোটাই কাটে কলকাতা শহরে। কলকাতার যোগমায়াদেবী কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময়ই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কর্মজীবনে প্রথমে বিভিন্নস্থানে চাকরি করে সরকারি চাকরিতে থিতু হন। কিন্তু ২০০৪ সালে পুরোপুরিভাবে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার জন্য চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন। প্রায় সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে সুচিত্রা ভট্টাচার্য অসংখ্য ছোটগল্প ও চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘মিতিন মাসি’র মতো নারী গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে গিয়েছেন যা পাঠকদের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ছোটগল্পগুলো দিয়েই মূলত তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো তাঁকে লেখক হিসেবে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাছের মানুষ, দহন, কাচের দেওয়াল, হেমন্তের পাখি, নীল ঘূর্ণি, অলীক সুখ, গভীর অসুখ, উড়ো মেঘ, ছেঁড়া তার, আলোছায়া, অন্য বসন্ত, পরবাস, পালাবার পথ নেই, আমি রাইকিশোরী ইত্যাদি। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস গল্প ‘দহন’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ সালে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও লেখিকার উপন্যাস অবলম্বনে ‘ইচ্ছে’, ‘রামধনু’, ‘অলীক সুখ’, ‘অন্য বসন্ত’ এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য এই বাঙালি নারী সাহিত্যিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার (২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার, ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার এর মতো নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আজীবন তিনি কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে বসে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। সেখানেই ২০১৫ সালের ১২ই মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।