"ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ" বইটির 'শুরুর কথা ' অংশ থেকে নেয়াঃ আপনাদের কথাটা হয়তাে বিশ্বাসই হবে না। অবশ্য সেটা সাধারণভাবে বিশ্বাস না হওয়ারই কথা যে, পৃথিবীতে যথাযথভাবে জীবন কাটাতে গেলে চারটি বিশেষ পথ অবলম্বন করা দরকার। এই চারটে বিষয় ধরেই প্রত্যেক মানুষের আসল বিচার ঘটে। অন্যেরাই সে বিচার করে জেনে রাখা চাই। বিষয় চারটি কি? হ্যাঁ, এই প্রশ্ন এই বই পড়তে শুরু করার আগে আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। আর তার উত্তরও আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। এবং তার উত্তরও আপনাকে পেতে হবে। শুধু পাওয়া নয়, জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে বেঁচে থাকতে গেলে তাকে কাজেও লাগাতে হবে। সেই চারটি বিষয় হল : ১। আমরা কী করি? ২। আমাদের বাহ্যিক আকৃতি কী? ৩। আমরা কীভাবে কী কথা বলি? ৪। আমাদের সেই বলার পদ্ধতি কী রকম? একটু ভেবে দেখুন কথাগুলাে। ভাবলেই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন মানুষকে এই প্রতিযােগিতাপূর্ণ বিশ্বে নিজের স্থানটি ঠিকমত আয়ত্ত করতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। আর সে কাজ করার জন্য উপরের চারটি বিষয়ই হলাে সবচেয়ে মনে রাখার মত। এ মত পদ্ধতিগত ব্যাপারে না ঢুকেও বলা যায় উপরের বিষয়গুলােই একজন সফল মানুষের সব সাফল্যের গােড়ার কথা। কথাটা অবশ্য এভাবে না বলাই ঠিক। কারণ এই বিষয়গুলাে কোন পদ্ধতি নয়। আসলে কাউকে বিচার করার পথ মাত্র। এই পথ দিয়েই একজন সফল মানুষের বিচার সম্ভব। কিন্তু বিচার করার ফলশ্রুতি কী? এ প্রশ্নও করা স্বাভাবিক। আসলে এগুলাে থেকেই একজন পরিপূর্ণ মানুষের সঠিক পরিচয় পেতে পারে সবাই। কী বলতে চাই নিশ্চয়ই সকলে উপলব্ধি করতে পেরে থাকবেন। হ্যাঁ, একজন সরল মানুষের সাফল্যের গােড়ার সেই কথাটাই বলতে চাই। অর্থাৎ চারটি বিষয়ের অর্থ হলাে একজন মানুষের সঠিক ব্যক্তিত্ব প্রকাশেরই চাবিকাঠি। এই পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কত? অন্তত কয়েক'শ কোটি তাে বটেই, এতাে একজন স্কুলের ছাত্রও জানে। অথচ ভাবলেও অবাক হতে হয় সেই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সফলতার মুখ দেখেন কজন? দেশে দেশে এমন মানুষের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে বড়ই নগণ্য। তাই না? এ কথা তাই সকলের স্বীকার করা উচিত সফলতা তাদেরই আসে যারা সঠিকভাবে তাদের জীবনকে পরিচালনা করতে পারেন। সেই জীবনকে পরিচালনা করে এগিয়ে নিতে তারাই তাই পারেন, জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত আর বাধা বিপত্তিকে যারা অনায়াসে জয় করতে পারেন। সবাই তা পারে না কেন? এখানেই আসছে ব্যক্তিত্বের কথা। সকলের ব্যক্তিত্ব কখনই সমানভাবে স্ফুরিত হয় না, হতে পারে না। এর মধ্যে অবশ্যই আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা কেউ কেউ করে থাকেন। ব্যক্তিত্ব প্রকাশ আর সাফল্যের জন্য এটাও অনেকটাই কাজ করে অনেকেরই ধারণা। সেটা কী? সঙ্গত প্রশ্ন, তাতে দ্বিমত নেই। সেটা হল ভাগ্য। অনেকেই বলে থাকেন ভাগ্য সহায় থাকলে অনেকখানি কাজ এগিয়ে দিতে পারে কিন্তু পৃথিবীর অসংখ্য কৃতী, সফল মানুষের জীবনী পর্যালােচনা করুণ একবার, দেখতে পাবেন যে সেখানে ভাগ্যের কোন স্থান নেই। বিশ্বের বহু মানুষই সামান্য অবস্থা থেকে শুধু মাত্র প্রত্যয় আর ব্যক্তিত্বের জোরেই সাফল্যলাভ করে স্মরণীয় হয়েছেন। সেখানে দারিদ্র্যও তাদের অগ্রগতি রােধ করতে পারেনি। বহু খ্যাতিমান মানুষ চরম দারিদ্র্যে প্রথম জীবন কাটিয়েও শেষ পর্যন্ত খ্যাতি এবং প্রাচুর্যের শিখরে উঠেছেন। এ ব্যাপারে একজনের নাম করতে পারি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর একনিষ্ঠ তিনি হলেন বিখ্যাত ইংরাজ ঔপন্যাসিক এইচ, জি, ওয়েলস। নিজের ব্যক্তিত্ব, অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের জোরেই তিনি খ্যাতিলাভ করেছিলেন, সফল হয়েছিলেন সাহিত্যিক হিসেবে। এরকম আর একজন মানুষ ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। ব্যক্তিত্বই তার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল। এরকম আরও অসংখ্য মানুষেরই নাম করা যায় যাঁরা তাঁদের জীবনে সেই চারটি বিষয় কাজের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের চরমতম শিখরে নিতে পেরেছিলেন। এমনই আর একজন ছিলেন ফরাসী সম্রাট নেপােলিয়ান বােনাপার্ট। ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সম্রাট নেপােলিয়ানের তুলনা ছিলাে না। সেনাবাহিনীর প্রত্যেকে তাঁকে অসম্ভব রকম শ্রদ্ধা করতেন। নেপােলিয়ান এরকম শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতেন কিভাবে? এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নেপােলিয়ানের এই অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অদ্ভুতভাবেই শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষের, অর্থাৎ ইংরাজদের হাতে বন্দী হয়েও তার ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল থেকে যায়। শােনা যায় নেপােলিয়নকে বন্দী করে সেন্ট হেলেনায় নিয়ে যাওয়ার সময় ইংরাজ সেনারা তাঁকে অভিবাদন জানায় তার অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে। ঠিক এ রকমই আবার লক্ষ্য করা গেছে তুর্কী সেনাধ্যক্ষ আর অবিসম্বাদী নেতা কামাল আতাতুর্কের ক্ষেত্রেও। একটা কথা তাই মনে রাখা দরকার। আর তা হল, যে কোন মানুষের জীবনে ব্যক্তিত্বই হলাে সাফল্যের মূল কথা। আর সেই কারণেই সেই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করাই আসল কাজ। আবারও সেই চারটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। ওই চারটি বিষয় নির্ভর করেই গড়ে ওঠে যেকোন মানুষের ব্যক্তিত্ব। আর তারই পরে স্বভাবতই এসে পড়ে সাফল্য। আরও কিছু বিষয় নিয়েও আলােচনা দরকার। কারণ এই ব্যক্তিত্ব যেমন গড়ে তুলতে পারা সম্ভব সেভাবে একজনের বাহ্যিক আকৃতির পরিবর্তন কি সম্ভব? না। এটাই হল উত্তর। শুধু তাকে কিছুটা বদলে নেওয়াই সম্ভব। আব্রাহাম লিঙ্কনের কথাটাই ধরুন। লিঙ্কন সুপুরুষ ছিলেন না। এজন্য তার ব্যক্তিত্ব ফুরণের কোন রকম অসুবিধা হয় নি। কারণ ব্যক্তিত্ব কেবলমাত্র বাইরের আকৃতির উপর নির্ভর নয়। ব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু থাকে যা অনায়াসেই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে তাদের বশে আনা সম্ভবপর। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ কদাচিৎ সফল হতে পারে। পৃথিবীর যেকোন দেশের ইতিহাস ঘাটলেই এ কথার সত্যতা আপনাদের চোখে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। একবার ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিসরেলী আর গ্ল্যাডস্টোনের কথাটা ভাবুন। ব্যক্তিত্বের জোরেই তারা ইতিহাসে খ্যাতিমান বলে পরিচিত হয়েছিলেন। সাফল্য তাঁদের অনুসরণ করেছিল সারা জীবন। নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অসম্ভব সচেতন ছিলেন জার্মানীর প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক। তাঁর এই ব্যক্তিত্বই তাঁর অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা আর সাফল্যের মূল কথা তাতে কোন রকম সন্দেহ নেই। কারও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে কেমন করে? এ কথার উত্তর আগেই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ হলাে মানুষ ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে অথচ পশুর একমাত্র সম্বল তার দৈহিক শক্তি। ব্যক্তিত্বের মধ্যে কখনও আকাঙ্ক্ষাকে জড়িয়ে ফেলা সমীচীন হবে না। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিত্ব থাকা সত্বেও অহঙ্কার তাদের বেশি এগুতে দেয় নি, এনেছে পতন। কলম্বাসের কথাই এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। মানুষের কতকগুলি ত্রুটির কথা স্বীকার করে নেওয়াই বােধ হয় ভালাে। যে কোন দুঃখজনক পরিস্থিতি বা জটিলতার আবর্তে পতিত হলে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই ভুল পথ গ্রহণ করে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব বা সাফল্য অনেককেই সঠিক পথ গ্রহণে সাহায্য করতে পারে। এজন্য অবশ্যই প্রয়ােজন নিঃসন্দেহে বাস্তববুদ্ধি আর সঠিক পথ গ্রহণে সক্ষমতা। এর মধ্যেই মানব চরিত্রের ব্যাখ্যা মিলতে পারে। পশুর সঙ্গে মানুষের তফাৎ এখানেও। মানুষের সফল হওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধাই আসে। সে বাধা নানাভাবে আসা সম্ভব। একটা উদাহরণ রাখা যাক। কোন মানুষের বিশেষ ব্যক্তিত্ব আর কার্যকরী ক্ষমতা থাকা সত্বেও সে হয়তাে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যর্থও হতে পারে, শতকরা একশ ভাগ সাফল্য যেহেতু কোন রকমেই আসতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অজস্র উদাহরণ চোখে পড়তে পারে। যেমন নেপােলিয়ান বােনাপার্টের জীবন। নেপােলিয়ান উদ্দাম ঝড়ের মতই সাফল্যের শীর্ষে আরােহণ করেছিলেন কিন্তু তার বিশাল সেনাবাহিনী রাশিয়া জয়ে সক্ষম হয়নি। এক্ষেত্রে নেপােলিয়নের ব্যক্তিত্ব সফল হতে পারেনি। কারণ বাধা হয়ে দাঁড়ায় রুশ সেনার প্রতিরােধ আর নিষ্করুণ প্রকৃতি। জীবনে সাফল্য আনার কাজে ব্যক্তিত্বকেই একমাত্র বড় করে দেখুন এমন কথা বলা হয়তাে বেশি বাড়াবাড়ি বলে মনে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই ভাগ্যের কিছু স্পর্শকে অস্বীকার করা উচিত নয়। হ্যাঁ, এর সঙ্গে চাই আরও একটা বস্তু। আর তা হলাে মানসিক শক্তি। এই মানসিক শক্তিই একজন মানুষকে চালনা করে নিয়ে যায়। এটাই হলাে যেকোন মানুষের চালনাশক্তি, গাড়ির জ্বালানী।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।