"একাত্তরঃ নির্যাতনের কড়চা" বইটির পুর্বকথা অংশ থেকে নেয়াঃ ১৯৭১ সাল। বাঙালী জাতির অস্তিত্বচেতনা শক্ত জমিনে প্রতিষ্ঠার কাল। যে-প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে মধুর, সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম স্বাধীনতা, সবচেয়ে বাস্তব পরিচয় বাংলাদেশ। পূর্ণ প্রাণের আকুল প্রার্থনার ফল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর উৎসাহের মতাে দীপ্ত এবং দৃপ্ত রক্তধারার সিঞ্চনে শ্যামলে সবুজে, ভেজা মাটির মন-মাতাল-করা সোঁদা গন্ধে ভরা একটি অনন্যসাধারণ সত্তা। যা কবলিত ছিলাে বিশ্বের হিংস্রতম শােষক-শাসরে তীক্ষনখ থাবায় এবং আমরা যা ছিনিয়ে নিয়ে পরম শ্রদ্ধায় আর ভালােবাসায় বিছিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর মানচিত্রে, অমিত সম্ভাবনার রক্তলাল সূর্যের সুমুখে। কিন্তু আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে মিশে-থাকা রবীন্দ্রনাথের অমর বাণী,-পূর্ণ প্রাণে চাওয়ার জিনিষ শূন্য হাতে চাইতে নেই। রক্তলাল সূর্যই সাক্ষী, আমরা তার মূল্যও দিয়েছি পূর্ণ হাতেই। যা ছিলাে আমাদের জন্মগত অধিকার, আর জীবনের আমানত, তার মুখ চেয়ে। সে-মূল্যের এক নাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এক দেহে এক প্রাণে রূপ নিয়ে সংগ্রাম, আর এক নাম শতবিধ ত্যাগস্বীকার তথা নির্যাতনভােগ। এই সংগ্রাম, ত্যাগস্বীকার আর নির্যাতনভােগর কালে প্রতিপক্ষ আমাদের কখনাে বাধ্য করে প্রাণ দিতে, কখনাে বিষয়-আশয়, কখনাে বা মান-সম্মান-ইজ্জত। তবু আমাদের সাম চলেছেই, চলেছেই, যত দিন না দুশমনের খড়গ কৃপাণ’-এর ঝনাৎকার থেমে গেছে, বিষদাঁত সমূলে ভেঙে পড়েছে। আমাদের জন্মগত অধিকার বাবদ এমনি মূল্য দিতে যারা আমাদের বাধ্য করেছিলাে, তারা ছিলাে নানা নামে পরিচিত। তাদের মূল দল আমাদের স্বদেশী, স্বজাতির মানুষের ছদ্মনামে হানাদার শ্বাপদবাহিনী। এবং তাদের দোসর ছিলাে দুটি। চরিত্রে তারাও ভণ্ড এবং শ্বাপদ। একটি হল ভারত থেকে পালিয়ে এসে এই দেশেরই আলাে-হাওয়ায় আশ্রয় নিয়ে, এরই মাটির রসে বেঁচে-যাওয়া কিন্তু আমাদের থেকে পৃথক সত্তায় এখানকার মানুষের বুকের ওপর মুরুবীর মতাে চেপে-বসা তথাকথিত মােহাজেরের দল। অন্যটি ঘরের শত্রু বিভীষণ। যারা নকল দেশপ্রেম প্রদর্শনের নাটমঞ্চে দেখা দিয়েছিলাে দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটি ইত্যাদির তকমা পরে। এই তিন দুশমনের সন্ত্রাসী কীর্তিকলাপের কোনাে তুলনা নেই। তৈমুর-চেঙ্গিসের বাহিনীর পর পৃথিবীর ঘৃণ্যতম হন্তা মার্কিন বাহিনী নাগাসাকি-হিরােশিমা-মাইলাইতে যা করেছে, নিষ্ঠুরতম জার্মান বাহিনী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরােপের নানা দেশে-বিশেষতঃ, রাশিয়ায় যে পাশবিক লীলায় মেতে উঠেছে, উক্ত তিন দুশমনের কুকীর্তি সেসবকেও লজ্জা দেয়। মার্কিন-জার্মান-পাকিস্তানী এই সব পশুর অপরাধ সুস্থ মানবিক চেতনার কোনাে মানুষ কখনাে ভুলে যায়নি, কখনাে তাদের ক্ষমা করেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর প্রায় পাঁচ দশক পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজও রাশিয়ার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মের সিংহভাগ জুড়ে থাকে জার্মান হানাদারদের বর্বরতার কথা। হিরােশিমা-মাইলাইয়ের প্রসঙ্গে মার্কিন মুলুকের নাম শুনে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এখনাে ঘৃণায় নাক সিটকায়। তাদের নিয়েও লেখা হয়েছে কতাে কাহিনী! কেবল জাপানে, ভিয়েতনামে নয়, সেসবের বাইরেও নানা দেশে। শুধু আমরা এক ব্যতিক্রম,-আজব এবং অকল্পনীয়। আমাদের সংগ্রাম আর প্রতিরােধের, ত্যাগস্বীকার আর নির্যাতনভােগের কাহিনী ছড়িয়ে আছে। দেশের প্রতিটি শহর-বন্দরের অলিতে গলিতে, প্রায় পঁচাত্তর হাজার গ্রামের প্রতিটি পরিবারে। তার কোনাে সংখ্যা নেই। সেসব কাহিনী আমাদের ইতিহাসের অঙ্গ। সেগুলির সমাহারই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। অথচ সেদিকে দৃষ্টি দানের কথা আমরা ভেবেছি কদাচিৎ। তার এক অনিবার্য ফল, সমাজে রাজাকার আর মুক্তিযােদ্ধার মর্যাদার আসনে অদলবদল ঘটছে। দ্বিতীয়তঃ, মৌলবাদের নবজনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল ভিত্তি বাঙালী জাতীয়তাবাদ হারিয়ে একজন তাে আমাকে মাস ছয়েক ঘােরানাের পর সাফ ‘না’ বলে দেন। তাঁদের এমনি ক্ষীণ উৎসাহ আর অনীহার কারণে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাদ পড়ে বা অতি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।