"কিরীটী অমনিবাস (৫ম খণ্ড)" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: ‘অদৃশ্য শত্রু’ ভিন্ন স্বাদের গল্প। এর সময় বেছে নেওয়া হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কাল। সে সময়কার কলকাতার পরিবেশ রচনায় লেখক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু তার কল্পতা কোথাও বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায়নি। পাত্রপাত্রী নির্বাচনে এবং খুনের উপকরণ সংগ্রহে তিনি যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাহিনীর মধ্যে এনেছেন, ফলে কাহিনীটিকে কোথাও অবাস্তব বলে মনে হয় না। এ গল্পে কিরীটী রায়ের আবির্ভাব অনেক পরে। কিরীটী রায় পাঠকের কাছে যে কত প্রিয় তা এ গল্প পাঠেই বােঝা যায়। তার আবির্ভাবের জন্য পাঠককে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, কেননা তার কাছে পাঠকের অনেক প্রত্যাশা। শেষ পর্যন্ত নিরাশ হতে হয় না, আমাদের সব প্রত্যাশাই মিটিয়ে দেয়। উৎকণ্ঠা (suspense) সৃষ্টি করা এবং শেষ পর্যন্ত। তা রক্ষা করা—এ দুটিই নীহারবাবুর সহজ আয়ত্তাধীন। নীহারবাবুর কাহিনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তিনি অকারণে কাহিনীকে পল্লবিত করেন না। প্রতিটি ঘটনা কাহিনীর অনিবার্য ধারায় সংঘটিত হয় এবং প্রতিটি চরিত্র কাহিনীর অপরিহার্য অঙ্গ। তার বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রতিটি ঘটনার বিশ্লেষণ পূর্বাপর কৌতূহল রক্ষা করে কাহিনীগুলােকে উপাদেয় করে তুলছে। এক নিঃশ্বাসে দৃঢ়পিনব্ধ কাহিনীর শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছুতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। ‘প্রজাপতি রঙ’ শ্বাসরুদ্ধকারী অপরাধ-কাহিনী। ওয়াগন ব্রেকারে’র দলকে ধরতে এসে সত্যসন্ধানী কিরীটী রায় কি ভাবে কতকগুলাে নিষ্ঠুর হত্যার রহস্য উদঘাটন করল এই কাহিনীটিতে তারই রােমাঞ্চকর বিবরণ শুনতে পাওয়া যায়। কাহিনীটি কেবল অপরাধ আর অপরাধীদের নিয়েই লেখা গল্প নয়, তার মধ্যে দুই বােন মাধবী আর সাবিত্রীর দুটি সরস চরিত্র আছে। একই বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বাইরের কোন মিল নেই—একজন মধ্যাহ্নের দীপ্তসূর্য, আর একজন ভােরের শুকতারা; একজন আলাে, একজন ছায়া। পাশাপাশি দুটি স্রোত বয়ে গেছে—একদিকে ভয়ঙ্কর হত্যার লীলা, আর একদিকে নতুন সম্পর্ক গড়ার স্বপ্ন।
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।