"কিরীটী অমনিবাস (১৩তম খণ্ড)" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: দ্বিতীয় উপন্যাস “নগরনটী”র প্লট বেশ মজবুত। ঘটনাবিন্যাস সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। আমার মনে হয় বর্তমান খণ্ডে এই কাহিনীটিই সব চেয়ে ভাল উতরেছে। একজন সুন্দরী নারী, তার অক্ষম স্বামী, তিনটি পুরুষ মক্ষিকা, একজন চিত্রাভিনেত্রী—এই সকলকেই নিয়ে গল্পের জট বেঁধেছে। বহুবল্লভা নায়িকা মালঞ্চ যে রাত্রে খুন হল সে রাত্রে তার তিনজন প্রণয়ীই তার কক্ষে প্রবেশ করেছিল। সেই সঙ্গে প্রাক্তন স্বামী ও চিত্রাভিনেত্রী। হত্যাকারী কে? শুধু মাত্র একটি চাবির সূত্র ধরে ধাপে ধাপে এগিয়ে কিরীটী যে পদ্ধতিতে আততায়ীকে ধরে ফেললেন তা সত্যই প্রশংসনীয়। “রক্তের দাগ” গল্পটি শুরু হয়েছে এক ভৌতিক পরিবেশে। সুদীপ রােজ রাত্রে বাড়ি ফেরবার সময় কার যেন পায়ের শব্দ শােনে, কে যেন তাকে অনুসরণ করে, তার গা ছমছম করে। কয়েকদিন আগে সে তপন ঘােষের খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিল, যার ফলে আসামী বেকসুর খালাস পেল। বারবনিতা মৃণালের ঘরে তপন খুন হয়। খুনের সঙ্গে জড়িত আছে তিন বন্ধু—যারা সকলেই এক চোরাকারবারের অংশীদার। গােয়েন্দা গল্পের একটি সাধারণ ফর্মুলা হল সমাপ্তিপর্বে সব চেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিকে অপরাধী বলে প্রমাণ করা। “রক্তের দাগ”-এ এই কৌশলটি প্রযুক্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অবিনাশবাবু আসল অপরাধী বলে প্রমাণিত হয়েছেন। শেষ গল্প “র-প্রিন্ট”-এর স্বাদ একটু আলাদা। এতে আন্তর্জাতিক গুপ্তচর চক্রের কার্যকলাপ বর্ণিত হয়েছে। ভারত সরকারের একটি গােপন দলিল বিদেশে পাচার করার অপচেষ্টা বানচাল করে দিলেন কিরীটী রায়। গল্পটি উপভােগ্য। কিরীটী যখন শেষ মুহুর্তে সমস্ত রহস্য উদঘাটন করে দিলেন, তখন আত্মহত্যা ছাড়া কোন পথ থাকল না মীনাক্ষী খাতনের, যে ছিল গুপ্তচর চক্রের মক্ষিরাণী। অপরাধীর মনস্তত্ত বিশ্লেষণে সিদ্ধহস্ত নীহাররঞ্জন। উপরন্তু তিনি জানেন কি করে একটি দৃঢ়পিনদ্ধ প্লট গড়ে তুলতে হয়। তাই অকারণ কাহিনীকে তিনি পল্লবিত করেন না। প্রতিটি ঘটনা কাহিনীর অনিবার্য ধারায় সংঘটিত হয় এবং প্রতিটি চরিত্র কাহিনীর অপরিহার্য অঙ্গ। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও পূর্বাপর কৌতূহল রক্ষা করে তিনি কাহিনীকে এমন গতিশীল করে তােলেন যে শেষ পৃষ্ঠায় না পৌঁছানাে পর্যন্ত আমাদের ‘সাসপেন্স’ অটুট থাকে। বাংলা সাহিত্যে রহস্য উপন্যাসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পিছনে নীহাররঞ্জনের অবদান অনস্বীকার্য।
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।