ঢাকা ও কলকাতা- দুই শহর, তাদের শরীর আলাদা, আত্মা এক। সেই একাত্মা শহর কখন আলাদা হয়ে গেল রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদির আড়ালে কে তা জানে! তবে এটা সত্য, কলকাতার যে-কেউ ঢাকায় পা দিলে কিংবা ঢাকার যে কেউ কলকাতায় পা দিলে- অন্তরের দৃশ্যপটে আলোড়ন ওঠে। পানিপুরি আর ফুচকার মিল-অমিলের আড়ালে চলতে থাকে দুই নগরের ইতিহাস ঐতিহ্যের ভেদাভেদ তত্ত্ব। তানভীর মোকাম্মেলের প্রথম উপন্যাস 'দুই নগর' ঢাকা আর কলকাতা-কেন্দ্রিক। কলকাতার মেয়ে জয়তী চক্রবর্তী ঢাকা আসে '৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে গবেষণার কাজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান তাকে এ গবেষণায় সহায়তা করেন। জয়তীর বাবা-মা একদা বাংলাদেশেই ছিলেন। সামন্ত জমিদার পরিবারের মেয়ে জয়তী এই সুযোগে নিজের পিতা-মাতার আদি আবাসটাও ঘুরে দেখে যায়। অকস্মাৎ এক বর্ষার রাতে সহযাত্রী রায়হানের সঙ্গে তার মিলন হলো। এই মিলন কি হিন্দু- মুসলমান, বাংলাদেশ-ভারতের মিলনের কোনো ইঙ্গিত!- না, তানভীর মোকাম্মেল কোনো সরল প্রেমের গল্পের আড়ালে আবেগি ইঙ্গিতে বিশ্বাসী নন। তাঁর 'দুই নগরের' কাহিনি হয়তো চার লাইনে বলা যায়, কিন্তু তার গভীরতা কাহিনির ছক-বাঁধা বলয় ছাড়িয়ে আরো দূর কোনো সীমান্তরেখায় ছুটে যায়।
দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি আছে তানভীর মােকাম্মেলের। সে পরিচিতি এই উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও । ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তানভীর মােকাম্মেল চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালিখিও করে থাকেন। প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, সব ধরনের লেখাতেই সিদ্ধহস্ত তিনি। সম্প্রতি উপন্যাস লেখা। শুরু করেছেন। গত বছর প্রকাশিত ওঁর “দুই নগর” উপন্যাসটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। ওঁর দ্বিতীয় উপন্যাস “কীর্তিনাশা” সাতচল্লিশের দেশভাগ ও বিক্রমপুর অঞ্চলকে ঘিরে “নদীর নাম মধুমতী”, “চিত্রা নদীর পারে”, “লালসালু”, “লালন”, “রাবেয়া”, “জীবনঢুলী” এসব ইতিহাসসচেতন চলচ্চিত্রের মতােই তানভীর। মােকাম্মেলের লেখালিখির ধরনটাও ইতিহাসমনস্ক ও মননশীল। ওঁর রচিত গল্প-উপন্যাস ও কবিতায় এমন গভীর একটা সমাজমনস্কতা ও ইতিহাস চেতনা রয়েছে যা ওঁকে বর্তমান সময়ের আর পাঁচজন লেখক থেকে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। তানভীর মােকাম্মেল এ পর্যন্ত বিশটির মতাে কাহিনী ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন, লিখেছেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালােচনামূলক বই, আর লিখেছেন প্রচুর কবিতা । ওঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মতাে ওঁর রচনাগুলােও হয়ে পড়েছে বাংলা নামের এই জনপদের কাল ও সময়ের এক নির্মিতি যা এক বিশেষ সময়কালকে ধারণ করলেও হয়ে উঠেছে কালাতিক্রান্ত। দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে।