‘চাঁদের অমাবস্যা’ বইয়ের ভূমিকাঃ কথানির্মাতা, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (জন্ম : ১৫ আগস্ট ১৯২২, মৃত্যু : ১০ অক্টোবর ১৯৭১) বাংলাসাহিত্যে নিজের জন্য একটি বিশেষ মনোযোগের অবস্থান তৈরি করে নিযেছেন তাঁর প্রজ্ঞা আর সমাজনিবিড় জীবন-অভিজ্ঞানের প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে। দেশ, আমাদের চারপাশের পরিচিত বলয়, রাজনৈতিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ও ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গ তাঁর সৃজনীভুবনকে শক্ত এক ভিতে দাঁড়াবার উপাদান যুগিয়েছে। মানুষের সামাজিক খ্যাতি, আর্থিক নির্ভরতা ও লোভ, নগরের বিকাশ এবং ফলত গ্রামীণ জীবনধারার ক্রম-বিলোপ, রাষ্ট্ৰীয় অভ্যন্তরীণ ও বহিনীতি, ভিন্ন সংস্কৃতির আলোয় ব্যক্তির চিন্তা প্রকাশের কৌশল ও বাস্তবতা প্রভৃতিকে তিনি সাহিত্যকর্মের ফ্রেমে আটতে চেষ্টা করেছেন শিল্পচর্চার পুরোটা কাল। লেখার পাশাপাশি তিনি চিত্রকর্মের যে চর্চা করতেন, সেখানেও ছিল ওই একই দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর তিনটি বহুল আলোচিত উপন্যাস (লালসালু, ১৯৪৮; চাঁদের অমাবস্যা, ১৯৬৪; কাঁদো নদী কাঁদো, ১৯৬৮), চারটি প্রশংসিত নাটক আর বাইশটি গল্পের বাইরে, তাঁর মৃত্যুর পর, আরো দুটি উপন্যাস আমাদের হাতে আসেএ গ্রন্থগুলো ইংরেজিতে লেখা, নাম যথাক্রমে দ্য আগলি এশিয়ান ও হাউ ডাজ ওয়ান কুক বীনস; খুব সম্পপ্রতিকালে বাংলা অনুবাদ কদৰ্য এশীয় (প্রথম প্রকাশ : ২০০৬) ও শিম কীভাবে রান্না করতে হয় (প্রথম প্রকাশ : ২০০৪ ঈদ সংখ্যা, দৈনিক প্রথম আলো) শিরোনামে ছাপা হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে। গ্রন্থ দুটি ভাষান্তর করেছেন শিবব্ৰত বৰ্মন। প্রথমটির বিষয় রাজনীতি- বাংলাদেশের ভিন্নরাষ্ট্রনির্ভরতা ও অসহায় বাধ্যবৃত্তি আর স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি এর প্রতিপাদ্য; দ্বিতীয়টিতে স্থান পেয়েছে সংস্কৃতির সমন্বয় কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক মেজাজ আত্মস্থ করবার প্রবণতা ও কৌশল। ওয়ালীউল্লাহর প্রকাশের ভার নিয়ে বিচিত্রমুখী পর্যবেক্ষণ হয়েছে, হচ্ছে; তবে আমাদের আজকের প্রসঙ্গ চাঁদের অমাবস্যার ‘চুম্বক-চরিত্র’ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর আত্ম-প্রবঞ্চনা এবং অস্তিত্ব-অন্বেষার বিষয়াদি। আর খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় প্রবেশ করবে আখ্যানটির প্রতিবেশ এবং ধর্ম কিংবা বিচার-বিবেচনা বিষয়ে লেখকের নানানকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়- কথাটি মিথ্যা নয় কিছুতেই। তারপরও বাঁচবার আকুলতা বুকে নিয়ে আর অমরতা লাভের অষুধের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সাড়ে তিন হাত নিরাপদ ও আপন প্লটের দিকে আমাদের নিবিড়-নিশ্চিত অভিযাত্রা। মানুষের বাঁচবার এই অশেষ আকুলতার কারণেই গোরস্থানের সামনের ফ্ল্যাটের চেয়ে লেকের পাশের ফ্ল্যাটটির দাম দাঁড়ায় অনেকটা বেশি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস-গল্প ও নাটকে ‘ভয়’, ‘চাঁদের আলো’, ‘অন্ধকার’ প্রভৃতি অনুষঙ্গ পরিবেশিত হয়েছে…
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।