"গণিত অলিম্পিয়াড সিরিজ ৯ম থেকে ১০ম শ্রেণি সেকেন্ডারি ক্যাটাগরি সংকলন -১" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মাত্র গণিতের পাঠ্যবই থাকে। পরীক্ষার সময় দেখা হয়, শিক্ষার্থীরা ঐ পাঠ্যপুস্তকটি মুখস্থ করেছে কী না! এমন দেশে গণিতের শিক্ষক হওয়া যায় গণিত না পড়েই। শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকের নিয়মে অঙ্ক না করে তাহলে সেটিতে শূন্য দেয়া হয়। সত্যি কী বিচিত্র এই দেশ! এমন একটি দেশে শিক্ষার্থীদের কাছে গণিত একটি ভীতিকর বিষয় হবে, শিক্ষার্থীরা গণিত আর বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকতে চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কী? কয়েক বছর আগে আমরা যখন গণিত উৎসব শুরু করি তখন তাই শিক্ষার্থীরা গণিত বলতে পৃষ্ঠাভর্তি দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্নের ভীতিকর জটলা নিয়ে হুমড়ি খেতাে। তবে এখন আর সেটি নেই। কিছুটা হলেও যুগ পাল্টাচ্ছে। আজকের শিক্ষার্থীরা গণিতকে আনন্দের একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে শিখছে। গণিত উৎসবগুলােতে তাদের সরব উপস্থিতি এটাই বলে দেয় যে, বাংলাদেশে গণিত তথা যুক্তিচর্চার নবজাগরণ ঘটছে। এসবই আমাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে শেখায়। কিছুদিন আগেও বাংলায় লেখা গণিতের বই বলতে সবাই কেবল পাঠ্যবইকেই বুঝতাে। এখন বাংলা ভাষায় সুন্দর সুন্দর গণিতের বই বেরােচ্ছে। এসব বই বাংলাদেশের গণিত আন্দোলনকে আরাে বেগবান করবে বলে আমার বিশ্বাস। সৌমিত্র চক্রবর্তীর লেখা এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণের বাইরে এ বইটি নিয়ে কিছু কথা বলার অবকাশ আছে। জ্যামিতিই বইটির মূল প্রতিপাদ্য, তবে গণিতের অন্যান্য বিষয়ও জ্যামিতির হাত ধরে বিভিন্ন আলােচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে। গণিতের একেবারে মৌলিক বিষয়গুলাে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সাধারণত মৌলিক বিষয়গুলাে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই নিরস প্রকৃতির হয়। তাই এ বিষয়গুলাের প্রতি শিক্ষার্থীদের একটা স্বাভাবিক অনাগ্রহ থাকে, যা তাদের জ্ঞানের ভিত্তিকে দুর্বল করে। কিন্তু লেখকের সুনিপুণ লেখনীতে এই বিষয়গুলােই হয়ে উঠেছে রহস্যগল্পের মতাে রােমাঞ্চকর! এ বইটি তাই শুধু গণিতের বই থাকে নি, হয়ে উঠেছে সাহিত্যকর্মও। ‘বিন্দু’র মতাে মৌলিক বিষয় থেকে শুরু করে ‘টপােলজি’র মতাে আধুনিক বিষয় এ বইতে স্থান পেয়েছে। আলােচনার পরিধি অনেক বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও কোথাও প্রাঞ্জলতার ঘাটতি হয় নি। বরং, বইটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যেতে পারে; অর্থাৎ বইটির কোনাে অংশের আলােচনা পড়তে গিয়ে যদি কোন প্রশ্ন জাগে, তবে তার উত্তর বইটির অন্যকোনাে অংশে পাওয়া যাবে—দ্বিতীয় কোনাে বইয়ের দরকার পড়বে না।
১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি রাজশাহীতে জন্ম বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ও লেখক সৌমিত্র চক্রবর্তীর। কাঞ্চননগর মডেল হাই স্কুল থেকে প্রাইমারি এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বই পড়ার নেশা ছোটবেলা থেকেই, আর এ বিষয়ে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে গেছেন তার বাবা-মা। তবে ক্যাডেট কলেজে পড়াকালে কলেজের লাইব্রেরিতে থাকা অনেক বিরল বইয়ের খোঁজ পেয়েছিলেন। সেসব বইয়ের মাঝে তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতো গণিতের বই। ফলে গণিতের প্রতি আগ্রহটা তার সহজাত, কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি জীববিজ্ঞানকেও আপন করে নিয়েছিলেন। অপরদিকে ঝিনাইদহ সরকারি স্বাস্থ্য সহকারী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ বাবা এবং ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার মায়ের অনুপ্রেরণাও তাকে প্রভাবিত করেছে। তাই চিকিৎসক হওয়ার আশায় তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা থেকে তিনি পাশাপাশি লেখালেখিও করছেন। সৌমিত্র চক্রবর্তীর বই লেখার ধাঁচ অনেকটা গবেষণাধর্মী, এছাড়াও বাংলায় সহজভাবে তিনি গণিত এবং বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে থাকেন যাতে করে সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়গুলো সহজ হয়ে দাঁড়ায়। সৌমিত্র চক্রবর্তী এর বই সমূহ এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘প্রাণের মাঝে গণিত বাজে’, ‘জীবনের গল্প’, ‘জীবনের গাণিতিক রহস্যঃ পপুলেশন জেনেটিক্স ও গেইম থিওরি’, ‘গণিতের সাথে বসবাস’, ‘খণ্ড ক্যানভাস’ ইত্যাদি। বই লেখার পাশাপাশি তিনি আরো কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি একাধারে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর, বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী এবং ময়মনসিংহ প্যারালাল ম্যাথ স্কুলের উদ্যোক্তা। তাঁর সময় কাটে অবসরে বই পড়ে ও প্রোগ্রামিং চর্চা করে। ২০২১ সালে "করোনা বৃত্তান্ত" বইয়ের জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃক "হালীমা-শরফুদ্দীন বিজ্ঞান লেখক পুরস্কার" -এ ভূষিত হয়েছেন।