শিবপ্রসাদ গুপ্ত যখন প্রথম এ-বাড়িতে এসেছিলেন তখন পাড়ার লোকেরা অনেকেই অযাচিতভাবে এসে দেখা করে গিয়েছিলেন। সেই যে তাঁদের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছিল, তার পর থেকে তা আর থেমে যায় নি ৷ লোকে বলতে—বড়লোক হলে কী হবে, মেজাজটা শিবের মত— শিবের মেজাজ আসলে কী রকম কে জানে। কিন্তু শিবকে ঠান্ডা মেজারের দেবতা মনে করে নিলে উপমাটা লাগসই করার পক্ষে সুবিধে হতো। আর তা ছাড়া শিবের চেহারার সঙ্গেও মিল ছিল শিবপ্রসাদবাবুর। শিবপ্রসাদবাবু বলতেন—না না, কী যে বলেন আপনারা, দিনকাল যে-রকম পড়েছে আজকাল তাতে মেজাজ ঠান্ডা রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে। আরো বলতেন—মেজাজ গরম করলে কি আর পাবলিকের সঙ্গে কারবার করা চলে বঙ্কুবাবু— একা বঙ্কুবাবুই শুধু নয়, পাড়ার কয়েকজন রিটায়ার্ড বৃদ্ধ সন্ধ্যেবেলা মাথা-গলা- কান ঢাকা দিয়ে এসে বসতেন। খবরের কাগজ নিয়ে আলোচনা হতো, কংগ্রেস কমিউনিস্ট নিয়ে আলোচনা হতো, প্রত্যেকের একটা করে বলবার মত বিষয় ছিল, সেটা তাদের অতীত জীবন। বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার চেয়ে অতীতটা নিয়েই বেশি মাথা ঘামাতেন সবাই। সেই অতীত জীবনের কথাই সকলের মনে পড়তো। কী-সব দিন-কাল ছিল মশাই! কোথায় গেল সেই সোনার দেশ! তখন লেখাপড়ার কদর ছিল, দেব-দ্বিজে ভক্তি ছিল । আর এখন সব উল্টে গেছে।
Bimal Mitra কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ। চেতনা স্কুল ও আশুতোষ কলেজে শিক্ষালাভের পর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে । গোড়ায় গান লেখার শখ ছিল । বিখ্যাত গায়করা তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন। পরে তিনি কথাসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম জীবনে রেল বিভাগে চাকরি করতেন। তারপর সে গল্প-উপন্যাস প্ৰবন্ধ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা একশতরও অধিক। বাংলা ১৩৭০ সালে তার সরকার রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে সংবর্ধিত করেন। এই উপন্যাসটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ মূল্যবান উপন্যাস। তবে সাহিত্য পুরস্কার লাভের থেকেও বিমল মিত্র সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বঙ্গভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের পর তিনিই সর্বভারতীয় সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন । তিনি বেগম মেরী বিশ্বাস, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, একক দশক শতক, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ-এপিক উপন্যাসের মাধ্যমে তিনশো বছরের সমাজজীবনের এক বিস্তৃতকালের চালচিত্র বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন । ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার তিরোধান হয় ।