'খেরো' শব্দটা বাংলায় এসেছে হিন্দি 'খেয়া' বা 'ডেয়া থেকে। এতে এক ধরনের মোটা কাপড় বোঝায়, যা নিয়ে প্রথাগতভাবে বালিশ বা গদি তৈরি হতো। পরে লম্বা কাগজের হিসাবের খাতা বাঁধানো হতো লাল রঙের এই মোটা কাপড় দিয়ে, আর তা জড়িয়ে রাখা হতো মোটা সুতোয়। তখন থেকে খেরোখাতা বলতে এগুলোই বোঝাত। নববর্ষে ব্যবসায়ীরা এমন নতুন খাতায় আগের বছরের জমা-খরচ-ইজার হালনাগাদ হিসাব তুলতেন। তা থেকেই হালখাতার উৎসবের শুরু। ব্যবসায়ীদের সেই হিসাবের খাতাই বেছে নিলেন শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর নিত্যদিনের কাজকর্মের বিবরণ আর চিন্তা-ভাবনা লিখে রাখতে। ১৯৭৭ সালের ৮ মে এর শুরু বাংলা ১৩৭৪ সালের ২৫ বৈশাখে। সেই থেকে ১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ৪৩টি খেরোখাতা তিনি রচনা করেছেন। তুলি দিয়ে, মোটা নিবের কলম দিয়ে, হরেক রঙে রেখা আর রেখার সমাহার। কখনো লিখছেন বা আঁকছেন লম্বালম্বি, কখনো আড়ে, কখনো কোনাকুনি। একই পাতায় দু'রকম, তিনরকম করে। তারিখ দিচ্ছেন, তাতে ভুলও হচ্ছে কখনো। অক্ষরে লিখছেন যে, সংখ্যায় লিখছেন জুন। তবে প্রতি পাতায় রয়েছে তাঁর অন্তরতম অভিব্যক্তি। কে এলো, কে আসবে বলে আসতে পারল না, কোথায় সভায় যাচ্ছেন, তাঁর ডিজাইন সেন্টারে কী নিয়ে আলোচনায় বসছেন কাদের সঙ্গে, কেউ বিলেত যাচ্ছেন—তাঁকে দিয়ে রংতুলি আনাতে হবে সেখান থেকে, কেউ অসহায় একটি মেয়ে পাঠাচ্ছেন—তার কাজ জুটিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের খবর – চিত্রপ্রদর্শনী, জন্য-মৃত্যুবার্ষিকী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংগঠনিক আয়োজন, রাজনীতি, সরকার— সবকিছু থাকছে তাতে। থাকছে আবহাওয়ার খবর। টাকা-পয়সার হিসাবও আছে ওই কাগজেই। কেউ তাঁর কাছ থেকে পাওয়া টাকার স্বীকৃতি লিখে রাখছেন, তিনি নিজেও উল্লেখ করছেন অন্যের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বিবরণ। দেশি-বিদেশি চিত্রকলা নিয়েও তাঁর নিজস্ব মন্তব্য আছে।