মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও এই সংক্রান্ত জটিলতা-প্রেম ও প্রতারণা; ‘মন্দ্রজাল’ উপন্যাসের বিষয় হয়েছে; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের শ্রেণি চেতনার অহং। যা থেকে অনেকসময় ক্রুদ্ধ মানুষ অমানবিক হয়ে ওঠে। ফেসবুকে মোবারকের ছদ্ম-আইডি ‘হায় চিল’। ‘হায় চিল’-এর সঙ্গে বিদিশা মুকাম্মিলের অদ্ভুত কথোপকথনের সূত্র ধরে এগিয়ে যায় দু’জনের সম্পর্ক। মোবারক একসময় বিদিশা মুকাম্মিলের আপিসে কাজের সূত্রে তার অধস্তন হয়। একদিকে বিদিশার আপিসে কর্মরত মোবারক, অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনে বিদিশার অন্তরঙ্গ ‘হায় চিল’। বিদিশা জানেই না মোবারক আর ‘হায় চিল’ এক মানুষ। বিদিশা অজান্তে দুই ধারায় প্রবাহমান দুই সম্পর্কে-একটিতে সে সামন্তীয় গোষ্ঠীপতি; অন্যটিতে নির্ভার ব্যক্তিমানুষ-মাঝে অসুখী দাম্পত্যে স্বামীর সঙ্গে বিদিশার অনবরত দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস-আর এসবকিছুর মধ্যে মোবারকের মধ্যে গড়ে ওঠা আত্মপরিচয়ের ক্রমবর্ধমান সংকট-‘হায় চিল’ ছদ্মপরিচয়ে তাকে গ্রহণ করতে বিদিশার অসুবিধা নেই; তবে আসল মোবারককে গ্রহণে বিদিশার সমস্যা কোথায়? সমস্যা শ্রেণিচেতনায়, সমস্যা বাস্তবতায়-আধো তন্দ্রা কি ক্ষণিক মোহে কারও অবলম্বন হয়ে ওঠা এক কথা; আর, সেই সম্পর্কটি যখন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে দাঁড়ায়-তখনই বাধা হয়ে আসে বিভিন্ন সামাজিক হিসাব। ঘটনাপরম্পরায় এই উপন্যাসের পাঠক অবিরত নানা মুখ ও মুখোশের মধ্যে নতুন নতুন বাস্তবতা আবিষ্কার করে-জানতে পারে, তীব্র প্রেমের আচ্ছন্নতায় মানুষ যেমন আকুল; আবার, প্রয়োজনে চরম নিষ্ঠুরতায় সে প্রেম ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। ভাস্কর্যপ্রতিম আশ্চর্য গদ্যে ‘মন্দ্রজাল’ উপন্যাসে মাহবুব আজীজ সমকালীন নাগরিক জীবনের আর্তি ও হাহাকার; সঙ্গ ও সঙ্গহীনতার অভিনব এক আখ্যান মেলে ধরেন। নাগরিকতার ফাঁপা খোলসের ভেতর প্রতারণা ও গ্লানির যে অচ্ছেদ্য মেলবন্ধন-মাহবুব আজীজ অনুচ্চ তবে একান্ত স্বরে তা উপস্থাপন করেন। সমকালীন জীবনাচরণের এ এক তীব্র পর্যবেক্ষণ-সরাসরি নয়; মৃদু-তবে তীক্ষ্ণ ও অতলস্পর্শী। এই উপন্যাস একইসঙ্গে সমকালীন ও চিরায়ত বোধের দ্বৈত অভিজ্ঞানবাহী। দৈনিক সমকালের সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাসের খণ্ডাংশ বিপুল পাঠকনন্দিত। সমকালীন কয়েকজন তরুণ-তরুণী-তাদের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ও অভিন্ন স্বপ্নের প্রেক্ষাপটে মুখোমুখি দাঁড়ায় এই উপন্যাসে। আর এর ভেতর থেকে চিরকালীন মানবিক বোধ ও জিঘাংসা যেন আরেকবার চিরায়ত হয়ে ওঠে মাহবুব আজীজের অনবদ্য কলমে।