ফ্ল্যাপে লিখা কথা পাকিস্তান মিলিটারি রাত একটায় যে অপারেশন শুরু করে তার নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ছিল ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে। অধিনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলি। তিনি শায়েস্তা করবেন ঢাকা নগরী। মেজর জেনারেল খাদেমের উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা ছাড়া বাকি দেশ শায়েস্তা করার।
জোছনা ও জননীর গল্প
যাত্রীদের প্রায় সবার হাতেই কিছু-না-কিছু বই। বেশ কয়েকজনের হাতে কোরান শরীফ। অনেকের হাতে প্রচ্ছদে কায়দে আযমের ছবিওয়ালা বই। এইসব বই এখন খুব বিক্রি হচ্ছে। এইসব বই হাতে থাকলে একধরনের ভরসা পাওয়া যায়। মনে হয়, বিপদ হয়তোবা কাটবে।
অনিল বাগচীর একদিন
একমাত্র মহাপুরুষদের কাছেই ব্যক্তিগত দুঃখের চেয়েও দেশের দুঃখ বড় হয়ে ওঠে। আমরা মহাপুরুষ না- আমাদের কাছে আমাদের কষ্টটাই বড় কষ্ট।
সূর্যের দিন
প্রসঙ্গ কথা তখন আমার বয়স মাত্র তেইশ। আবেগ ও কল্পনায় হৃদয় টইটুম্বুর। বেঁচে থাকাটাই যেন পরম সুখের ব্যাপার। সবকিছুই ভালো লাগে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় আজকের আকাশটা যেন অন্যাদিনের চেয়ে বেশি নীল। গাছের দিকে তাকালে মনে হয় গাছের পাতা এত সবুজ হয় কেন? কারণ ছাড়াই আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে। সারাক্ষণ মনে হয় পৃথিবীতে এত সুখ কেন?
ঠিক তখন শুরু হল ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন। এরপর একাত্তরের বাঁচা-মরার যুদ্ধ। ভাবুক কল্পনাবিলাসী একটি যুবকের ধরাবাঁধা জীবন ভেঙে টুকরো টকরো হয়ে গেল। কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! ভাই-বোন এবং মাকে নিয়ে পালিয়ে আছি বরিশালের একটি গ্রামে। আশেপাশের গ্রামগুলো পপাকিস্তানি সেনারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে মিলিটারি এই গ্রামেও আসতে পারে। কি নিদারুণ আতঙ্ক! ঝীবনানন্দের নদী দিয়ে ভেসে যেত মানুষের লাশ। সারাক্ষণ মনে হত আমি নিশ্চয়ই কোনো এত কুৎসিত স্বপ্ন দেখছি। এই দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। দেখব সব আগের মতোই আছে। দুঃস্বপ্ন কিছু কাটে না। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী জগদ্দল পাথর হয়ে বুকের উপর চেপে থাকে।
একদিন খবর এল আমার ভালোমানুষ বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। এই খবর পাওয়ামাত্র পাওয়ামাত্র গ্রামের লোকজন আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমাদের কারণে মিলিটারির কোপানলে তারা পড়তে রাজি নয়। রাতের অন্ধকারে সবাইকে নিয়ে নৌকায় উঠেছি। কোথায় যাব কিছুই জানি না। আহ কি কষ্ট, কি কষ্ট!
বরিশালে থেকে কীভাবে আমার মহামহের বাড়ি ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে পৌছলাম সেই গল্প যন্ত্রণার গল্প। পৌঁছে দেখি সেখানেও একই অবস্থা। মিলিটারিরা ঘাঁটি বসিয়েছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে যুবক ছেলেদের। বাঁচার একমাত্র উপায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়া। আমি ভীতু ধরনের মানুষ। পারিবারিক বিপর্যয় আমার মনোবলও টুকরো করে দিয়েছে। কাজেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে চলে এলাম ঢাকায়, কারণ তখন ঢাকা মোটামুটি নিরাপদ এরকম কথা শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার নাকি চেষ্টা করছে রাজধানীকে স্বাভাবিক দেখাতে।
চেনা ঢাকা নগরী তখন অচেনা। রাস্তায় হাঁটতেও ভয় ভয় লাগে। এই বুঝি ধরে নিয়ে গেল। উঠলাম মহসিন হলে। অল্পকিছু ছঅত্র সেখানে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কুলে দেয়া হয়েছে। আমার কাছে জায়গাটা বেশ নিরাপদ মনে হল।
যখন একটু কমেছে রাতে ঘুমুতে পারি, বার বার গুম ভাঙে না, ঠিক তখন মিলিটারিরা আমাকে এবং চারজন ছাত্রকে রে নিয়ে গেল। স্থান হল বন্দিশিবিরে। মুক্তিযুদ্ধকে আমি দেখেছি যুবকের চোখে এবং দেখেছি খুব কাছ থেকে। জীবন এবং মৃত্যুকে এত ঘনিষ্ঠভাবে কখনো দেখব ভাবিবি। এত বিচিত্র আবেগ, কত বিচিত্র অনুভূতি! অথচ লেখালেখি মুরু করার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই সব আবেগ ও অনুভূতি আমার লেখায় আসছে না। যেন মুক্তিযুদ্ধ আমার আড়ালে ঘটে গেছে! মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আমার প্রথম লেখাটি লেখা হয় মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর। নাম শ্যামল ছায়া। একটি ছোট গল্প যা বাংলা একাডেমী পত্রিকা উত্তরাধিকারে প্রকাশিত হয়। তার প্রায় এক বছর পরে শ্যামল চায়া নামে একটি উপন্যাস লিখি। একদল মুক্তিযোদ্ধা একটা থানা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এই হচ্ছে উপন্যাসের বিষয়। এক রাতের কাহিনী। উপন্যাস হিসেবে হয়তোবা উৎসে যায় কিন্তু আমার মন ভরল না। মনে হল আমি পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো বিশাল ব্যাপার ধরার মতো ক্ষমতাই হয়তোবা আমার নেই। মন খারাপ হয়ে গেল। অনেকবার চেষ্টা করলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে-পারলাম না। কেন পারছি না সেও এক রহস্য। দশ বছর পর লিকলাম সৌরভ-মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঢাকা নগরীর মানুষের জীবনচর্যার গল্প। আমার কাছে মনে হল অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর কিছুটা সৌরভে দরা পড়েছে। খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। লেকা হল ১৯৭১, আগুনের পরশমণি, সূর্যের দিন। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা এইসব লেখায় ধরা পড়েছে এমন দাবি আমার নেই। দাবি এইটুকু- আমি গভীর ভালোবাসায় সেই সময়ের কিছু ছবি ধরতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তার বিচারের ভার আজকের এবং আগামীদিনের পাঠকদের ওপর।
মাওলা ব্রাদার্স আমার মুক্তিযুদ্ধের একত্র করেছেন, তাঁদের ধন্যবান।
হূমায়ূন আহমেদ ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ শহীদুল্লাহ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র শ্যামল ছায়া নির্বাসন ১৯৭১ সৌরভ আগুনের পরশমণি সূর্যের দিন অনিল বাগচীর একদিন জোছনা ও জননীর গল্প দেয়াল
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।