ভূমিকা আমাদের চারপাশের চেনা জগৎ এবং চারপাশের বাইরে অচেনা জগৎ নিয়ে আমার নিজের কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে। মাঝে মাঝে আমার অনিন্দ্রা রোগ হয়। বাসার সবাই ঘুমিয়ে থাকে আমি বারান্দায় বসে সিগারেটের পর সিগারেট টেনে হার্ট, ফুসফুসের যত রকম ক্ষতি করা সম্ভব ক্ষতি করতে থাকি। আর তখন অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনা আসতে থাকে। মনে হতে থাকে- আমাদের এই শরীরের ভেতর আছে আরেকটি শরীর, আমাদের এই জগতের ভেতরে আছে আরেকটি জগৎ। সেই জগৎ সম্পর্কে লিখলে কেমন হয়? শূন্য নামের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখার এই হল ‘শানে নজুল।’ শূন্য বইটিতে যুক্তির চেয়ে কল্পনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখার সময় লেখককে সচেতনভাবে কল্পনা পরিহার করে যুক্তিতে থাকার চেষ্টা করতে হয়। আমি কখনো তা পারি না। আমি শ্রদ্ধা করি- যুক্তি, কিন্তু ভালবাসি-কল্পনা। আর এটা তো জাগতিক সত্য ভালবাসার এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভালবাসাই জয়ী হয়। আমার এই কল্পকাহিনী যদি পাঠক-পাঠিকাদের কিছুটা হলেও দ্বিতীয় জগৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে তাহলেই আমার অনিদ্র রোগে রাত জাগা সফল হবে। জয় হোক অনিদ্রার।
হুমায়ূন আহমেদ এলিফেন্ট রোড ২২-০২-৯৪ সারাংশ এই সায়েন্স ফিকশনের মূল চরিত্র হল মনসুর সাহেব। তিনি একজন স্কুল-শিক্ষক। তার পরিবার-পরিজন বলতে তেমন কেউ নেই। একা একা থাকেন। আর দিন-রাত গণিতের বিভিন্ন জটিল জটিল সমস্যা নিয়ে ভাবেন। এক রাতে তিনি ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফেরার সময় বজ্রাহত হন। তারপর থেকে তার মধ্যে বিভিন্ন অপ্রকৃতস্থতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি একজনকে সব সময় তার সাথে দেখতে পান, যে কি না নিজেকে শূন্য জগতের বাসিন্দা বলে দাবি করে। সে যুবক আরও দাবি করে যে সে মনসুর সাহেবকে সাহায্য করার জন্যে এসেছে। এরপর থেকে লেখক গল্পে বিরাট মায়াজাল সৃষ্টি করেছেন। এই শূন্য জগত থেকে আসা যুবক যাকে মনসুর সাহেব তার প্রিয় রাশিমালার নামে ফিবোনাক্কি বলে ডাকেন, তার কি আসলেই বাস্তব জগতে কোন অস্তিত্ব আছে না কি সে শুধুই মনসুর সাহেবের কল্পনা? এই প্রশ্নের উত্তর গল্পের শেষে পাওয়া যায়। এদিকে দেখা যায় মনসুর সাহেব ফিবোনাক্কি রাশি ব্যবহার করে এক জটিল গাণিতিক রহস্য সমাধানের প্রায় দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছেন। যেই সমস্যা মনসুর সাহেবের দাদা এবং বাবাও সমাধান করার চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ তারা তিন পুরুষ ধরে এই কাজটি করছেন। কিন্তু মনসুর সাহেবের কোন উত্তরাধিকার না থাকায় তাকে এই সমস্যাটা সমাধান করতেই হবে। এদিকে তার শরীরও ক্রমশই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তিনি কি পারবেন এই সমস্যার সমাধান করতে? মনুষ্য জাতি কি সক্ষম হবে এমন এক রহস্যের সমাধান বের করতে যা তাদেরকে শূন্য মাত্রার জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে? ‘শূন্য’ বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এখানে গল্পের কাহিনী বিজ্ঞানের খুব কাছাকাছি থেকে তৈরি করা হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।