ভূমিকা দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বাংলার পুরনারী' একটি অনবদ্য সাহিত্য-সৃষ্টি। পূর্ব বাংলার গ্রাম্য কবিদের কাব্যগাথায় বাংলার নারী যেভাবে প্রতিভাত হয়েছে তারই অসমান্য কাব্যমিশ্রিত গদ্যরূপ এই পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। ইংরাজি ভাষায় যাকে বলে romanticized perception of women, এই গদ্যরূপে ধরা কাব্যগুলির সারাংশ তাই। নারীর আত্মত্যাগ, তার তিতিক্ষা, তার সহিষ্ণুতা, তার ক্ষমা, তার প্রেম, তার সন্তান বাৎসল্য, তার পতিভক্তি, তার স্বামী সোহাগিনী থাকার বাসনা, তার সতীত্ব—এই সকল সামাজিক গুণকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এই গল্পগুলিতে। বিপদে পড়ে নারীর উপস্থিত বুদ্ধি, তার সাহস, সততা, দৃঢ়তা, পরপুরুষের লোভাতুর আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার ক্ষমতা এ সবই এক ঘনীভূত আতিশয্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে এ সমস্ত কাব্যগীতে। এ সমস্ত গল্পকাহিনীতে কোন সমাজ বিপ্লবের কথা নেই— থাকার কথাও নয়। কারণ গ্রাম জীবনের আত্মমগ্নতায়, কৃষি-অর্থনীতির অন্তর্বদ্ধতায় সেখানে কোন বৃহত্তর উৎক্ষেপন সম্ভব ছিল না । গতিশীল জীবনচর্যার প্রবণতাগুলি যা শিল্পায়িত সমাজে দেখা যায় তা গ্রামজীবনে অনুপস্থিত ছিল। নারী সেখানে জীবনের একমাত্র সুষমা — পুরুষ তার রূপ ও শক্তি, তার বল ও ঐশ্বর্য নিয়ে আসে নিজেকে চরিতার্থ করার জন্য নয়, নারীকে ব্যঞ্জনাময় করার জন্যে। প্রতিটি উপাখ্যানের শেষে দীনেশচন্দ্র নারী চরিত্রকেই বিশ্লেষণ করেছেন, পুরুষকে নয়। কারণ গ্ৰাম্য কবিরা নারীকেই তাঁদের কাব্যরসের প্রেরণা হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। এটি ভারতীয় কবিদের আদি চেতনা। কালিদাস নারীকে ‘সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতু – সৃষ্টির আদি ধাতু বলে বর্ণনা করেছেন। সৃষ্টির এই আদি ধাতুই এই গ্রন্থের নানা গল্পে নানা রূপে পরিবেশিত হয়েছে। গল্পের নারী চরিত্রগুলি সবই স্বতন্ত্র;প্রত্যেকেই আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। কেউ কারও পরিপূরক নয়।। দীনেশচন্দ্র লিখলেন : “এদেশে যে সকল কবি প্রাচীন কালে মহিলা-চরিত্র আঁকিতে গিয়াছেন, তাহার সমস্ত স্থানেই সে সকল চরিত্র সীতা-সাবিত্রীর ছাঁচে ঢালাই করা হইয়াছে; কিন্তু বাঙ্গালার এই পল্লীর ঐশ্বৰ্য্য কি বিরাট!” (কাজলরেখা, পৃ. ৫৭)। একই চরিত্রের পৌনঃপুনিকতা এই গল্পগুলির মধ্যে নেই। এক বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের মাঝে নানা সাজে, নানা রূপে তাদের উপস্থাপনা। সব চরিত্র যে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নয় – রোমান্টিকৃত নারীর রূপ— যাকে ইংরাজিতে বলা হয় the roman ticized image of women – তাতে কখনো তা হয় না।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী-প্রতিমা” (মানসী, উপহার )
(১৮৬৬-১৯৩৯) ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার বগজুরী গ্রামে জন্ম নেন দীনেশচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ম-বিশ্বাস অনুসারী শিক্ষক-উকিল ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী রূপলতা দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকে বাংলা ভাষা ওসাহিত্যের গবেষণায় তিনি সাধক হয়ে ওঠেন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ. (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ছাত্ররূপে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। তিনি হবিগজ্ঞ হাইস্কুল, কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার নিযুক্ত হন এবং পরের বছরই তিনি সিনেট সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলাে নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। পরের বছর তাঁকে ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) উপাধি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অসম্ভব নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মতাে মানবপ্রেমী সমাজে দুর্লভ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি জসীম উদ্দীনকে দীনেশচন্দ্র সেনের পিতৃতুল্য অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। পূর্ব বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা (পুঁথি) সংগ্রহে বিশেষভাবে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে কবি জসীম। উদদীন কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলার প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন বিশাল ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে কাব্যগ্রন্থ, ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর সত্তরখানা অত্যন্ত মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করান এবং নিজে ইংরেজীতে ‘History of Bengali Language and Literature' পুস্তক রচনা করেন; এই বইটি রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়ার পথ সুগম করে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ইহলােক ত্যাগ করেন।