অধ্যায় - ১ সমাজতত্ত্বের স্বরূপ [Nature of Sociology ]
অধ্যায়সূচী (১। সমাজতত্ত্বের গোড়ার কথা ২। সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ৩। সমাজতত্ত্বের উদ্ভবের সহায়ক কারণসমূহ ৪।প্রাথমিক অবস্থায় সমাজতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ ৫। সমাজতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক প্ৰকৃতি ৬। সমাজতত্ত্বে মূল্যবিচার ৭। সমাজতত্ত্ব পাঠের উপযোগিতা)
১.১ সমাজতত্ত্বের গোড়ার কথা (Prelude of the Study of Sociology )
নবীন সামাজিক বিজ্ঞান !! মানুষের সামাজিক জীবনধারা বহুমুখী। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারার এক একটি দিক নিয়ে স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। সমাজতত্ত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সামাজিক বিষয়াদিকে সমাজবিকাশের বহুমুখী ধারা, সমস্যাদি ও সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে সুশৃঙ্খলভাবে পর্যালোচনার তাগিদ ও উদ্যোগ থেকেই। সমাজতত্ত্ব হল অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের সামাজিক বিজ্ঞান। বহু ও বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে সমাজতত্ত্ব হল অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের বিষয়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজতত্ত্বের মিথষ্ক্রিয়া সতত সম্পাদিত হয়। সামাজিক ; বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সমাজতত্ত্ব নিতান্তই নবীন। বটোমোরের (T.B. Bottomore) অভিমত অনুসারে স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে সমাজতত্ত্বের বয়স এক শতাব্দীর অধিক হবে না। Sociology শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন : “... Sociology is a modern science, not much more than a century old." কিন্তু সমাজের মধ্যে মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাসের বিষয়টি আজকের নয়, আবহমান কালের। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ কোন-না-কোন সমাজে বসবাস করে আসছে। এবং শুধু তাই নয় এই সমাজ ও গোষ্ঠীজীবন সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা সুদীর্ঘকালের। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দার্শনিক, চিন্তাবিদ, আইনবিদ প্রভৃতি মানুষের সমাজজীবন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করেছেন। তাঁদের সংশ্লিষ্ট রচনায় এ সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত পাওয়া যায়। এ সমস্ত মতামতের প্রাসঙ্গিকতা আধুনিক সমাজতত্ত্বেও অনস্বীকার্য। বটোমোর এ প্রসঙ্গে বলেছেন : “..we can find, in the writings of philosophers, religious teachers and legislators of all civilizations and epochs, observations and ideas which are relevant to modern sociology. Kautilya's Arthashastra and Aristotle's Politics analyse political systems in ways which are still of interest to the sociologists.” এতদ্সত্ত্বেও অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে 'সমাজতত্ত্ব’ নিতান্তই নবীন। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ্ র্যাডক্লিফ-ব্রাউন (A.R. Radcliffe - Brown)-কে অনুসরণ করে বটোমোর বলেছেন : “...the science of human society is as yet in its extreme infancy."
সমাজতত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা II মানবজীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর সামাজিক চরিত্র। ‘মানুষ সামাজিক জীব’— এ উক্তি বিশিষ্ট গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। বস্তুত প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষকে সমাজের মধ্যেই বসবাস করতে হয়। সমাজের মধ্যে মানুষের আচার-আচরণ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত দু'টি শক্তির দ্বারা। এই দু'টি শক্তির একটি হল প্রাকৃতিক এবং অপরটি সামাজিক। এই শক্তি দু'টিকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণের ব্যাপারে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষের উদ্যোগ-আয়োজনের অবধি নেই। প্রাকৃতিক শক্তিকে জানা ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে আগে। কারণ প্রাকৃতিক উপাদানসমূহই সুস্পষ্টভাবে প্রথমে প্রতিপন্ন হয়েছে। এবং প্রাকৃতিক উপাদানগুলিই অনুধাবনের ব্যাপারে মানুষ আগেই আত্মনিয়োগ করেছে। সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কেও মানুষের চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত ঘটেছে সুপ্রাচীন কালে। কিন্তু প্রাচীনকালে মানুষ শুধু সমাজকে নিয়েই ভাবনা-চিন্তা শুরু করেনি। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন-ধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে সে এই সময় অনুসন্ধান চালিয়েছে। এবং এই অনুসন্ধানের ফল হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ধনবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের। এই সমস্ত সামাজিক বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি সমাজস্থ ব্যক্তি বর্গের জীবনাধারার নির্দিষ্ট একটি দিক নিয়ে আলোচনা করে, এবং সেই বিষয়ের আলোচনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে। তবে সাধারণভাবে সকল সামাজিক বিজ্ঞানই মানবসমাজ ও সমাজবাসীদের জীবনচর্চার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে।