উপাখ্যান পেরিয়ে উপন্যাস ‘বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা' দেবার ফলে শাসনের ও শোষণের নিয়মে কলকাতা শহরে কিছু বেনিয়ান মুৎসুদ্দি গোষ্ঠী গড়ে উঠল এবং বাংলা তথা ভারতব্যাপী জমিতে মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীর উদয় হলো। শাসনের জন্যে পরিকাঠামোয় কেরানি-কর্মচারি এলো, যারা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক গোষ্ঠী বলে পরিগণিত হলো। এঁরাই ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে আত্মোন্নতির সুযোগ খুঁজলো। স্মরণ করা যেতে পারে, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, মুদ্রাযন্ত্রের প্রসার, সংবাদপত্রের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটতে থাকে এই কাল থেকেই। ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি হিন্দুসমাজে একটা আলোড়ন এসেছিল। মনীষী রামমোহন রায় তার অগ্রদূত, 'ইয়ং-বেঙ্গল' হলো ধ্বজাধারী, ‘তত্ত্ববোধিনী'র অক্ষয়কুমার দত্ত—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হলেন যুক্তিবাদের শিক্ষাগুরু। খুব সীমাবদ্ধ হলেও তখন শহুরে ‘বাবু’দের সঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তাদের সামনে ত্রিপদ বাধা। একদিকে বিদেশি শাসনের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, অপরদিকে ধর্ম-জাতি-বর্ণের ছুঁৎমার্গের সঙ্গে বাল্যবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষারোধ ও বিধবা বিবাহের বিরোধিতা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো জ্ঞানোন্মেষ সত্ত্বেও ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশে বাধা। শিক্ষিত মধ্যবিত্তই আবার পথ অন্বেষণে ব্রতী হলো। উনিশ শতকের সূচনা থেকেই অদ্ভুত রসাত্মক উপকথা, নক্শা জাতীয় রচনা এবং ইতিহাস-আশ্রিত কাহিনির ধারায় উপাখ্যান গড়ে উঠছিল। উইলিয়াম কেরীর ইতিহাসমালা'-র কিছু গল্পে, রামগতি ন্যায়রত্নের ‘রোমাবতী”-তে, রামসদয় ভট্টাচার্যের ‘অদ্ভুত উপন্যাসে', হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্তে’, মধুসূদন চক্রবর্তীর ‘মধুমল্লিকা বিলাসে’ আদি রসাত্মক বা অদ্ভুত রসাত্মক কাহিনির ধারাটি দানা বেঁধে উঠেছিল।