ভূমিকা ‘আরবদের নৌবহর’ আসলে একটি ঐতিহাসিক বক্তৃতামালা, যা প্রদান করেছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলাম বিশারদ আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.) । মুম্বইয়ের বিখ্যাত ইসলামিক রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে ১৯৩১ সালের ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ মার্চ তিনি এই মূল্যবান ভাষণ দেন। মধ্যযুগের ইতিহাসের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ওপর তিনিই প্রথম আলোকপাত করেন। এই দুরূহ বিষয়টি অনুধ্যানের জন্য আরবি ছাড়াও তাঁকে অতি অভিনিবেশ সহকারে পারসি, হিন্দি, চিনা, গ্রিক, লাতিন প্রভৃতি ভাষার চর্চা করতে হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে আল্লামা তাঁর ভাষণটি লিখেছিলেন আরবিতে। কুরআনের ভাষা এবং জান্নাতের ভাষা আরবিতে তিনি মাতৃভাষার মতোই সাবলীল ছিলেন। ফলে তাঁর ইসলাম চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল আরবি ভাষা । প্রায় বছর দশেক পরে সমগ্র ভাষণটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র এবং আজমগড়ের সুপ্রসিদ্ধ ‘দারুল মুসান্নেফিন শিবলী আকাডেমি'র যুগ্ম সচিব সাইয়েদ সাবাহউদ্দিন আবদুর রহমান। অনুবাদকালে লেখক জীবিত ছিলেন। ফলে সমগ্র অনুবাদটিই তিনি নিজে যাচাই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হায়দরাবাদের Islamic Culture নামে একটি ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনে দুটি পর্যায়ে সেগুলি প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি, এপ্রিল ও অক্টোবর এবং ১৯৫১ সালের অক্টোবর সংখ্যায়। এরপর ১৯৫৩ সালে আল্লামা প্রয়াত হন। ফলে ১৯৬৪ সালে ভাষণগুলি যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, সে-বই তিনি দেখে যেতে পারেননি। আলোচ্য গ্রন্থটি সেই সংস্করণের বাংলা ভাষান্তর । বিষয়ের জটিলতা সত্ত্বেও আমি যথাসম্ভব সহজ ও সাবলীল ভাষায় অনুবাদের চেষ্টা করেছি। অনুবাদের কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন মাওলানা আহম্মদ হুসাইন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর ঋণ অপরিশোধ্য। তাই ঋণ স্বীকার করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বইটি যদি আলোচ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ, জিজ্ঞাসা এবং আরও জানার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে তাহলে আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
ভারত-উপমহাদেশে সিরাতচর্চা, ইতিহাস ও আরবিভাষার সাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণামূলক কাজ করেছেন, কর্মগুণে হয়েছেন বিশ্ববরেণ্য—সাইয়েদ সুলাইমান নদবি রহ. তাদের সবচেয়ে অগ্রসারির। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বিহারের দিসনাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিখ্যাত নদওয়াতে পড়াশোনা করে সেখানেই দীর্ঘ দিন আরবিভাষার পাঠদান করেন এই প্রাজ্ঞ প্রতিভাধর; পাশাপাশি ছিলেন আন-নদওয়া আরবি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। কর্মজীবনে শিক্ষকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ, প্রদান করেছেন পৃথিবীখ্যাত সিরাত-বিষয়ক ভাষণ—খুতুবাতে মাদরাজ নামে যা বিশ্ববিখ্যাত। সিরাতুন নবি (যুগ্ম), সিরাতে আয়েশা, আরদুল কুরআন, খৈয়ামসহ যা-ই তিনি লিখেছেন, সেটিকেই করে তুলেছেন পাঠ-অনিবার্য। এসব আকরগ্রন্থ তাকে এনে দিয়েছে অমরত্বের মর্যাদা। তার লেখা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিগুলো শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা পার হয়ে হৃদয়কেও স্পর্শ করে প্রবলভাবে।