ভূমিকা রামায়ণের আবেদন শুধু ভারতের ক্ষেত্রেই নয়, পৃথিবীর সব দেশের মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে তার প্রভাব আছে, কারণ মানবিক মূল্যবোধ। মানবিক মূল্যবোধের জন্য মানুষের যে চিরায়ত স্বপ্ন বা তৃষ্ণা তা রামায়ণ পূরণ করে। রামায়ণের ঐতিহ্য তাই ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি জীবনে রামায়ণের প্রভাব সর্বত্রই। রামায়ণ শুধু ভারতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেনি, বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সংখ্যার পরিসংখ্যানে রামায়ণের প্রভাব পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মনে। হোমারের ইলিয়দ ও ওদিসির প্রভাব পশ্চিমী সাহিত্যে থাকলেও রামায়ণের মতো তা পশ্চিমী সমাজজীবনে প্রবেশ করেনি, বা সমাজ জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি। রামায়ণের প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়াও তিব্বত, মালয়, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ফিলিপাইন্সের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে যেমন আছে—আরবিক, উর্দু, পার্শিয়ান শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। এমন কি ব্রাজিলীয়, বুলগেরিয়ান, বার্মিজ, কাম্বোডিয়ান (খেমের), চিনে, চেকোশ্লোভাকিয়ান, মিশরীয়, ফরাসি, জার্মান, হিব্রু, হাঙ্গারিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, ইতালিয়ান, জাপানি, লাওশিয়ান, লাতিন, নরওয়েইয়ান, পোলিশ, রুশ, স্প্যানিশ, সুইডিশ, তার্কিশ, থাই, ইউক্রেনিয়ান, উজবেক ইত্যাদি ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রামায়ণ প্রভাব ফেলেছে। এ এক অবিশ্বাস্য তালিকা। রামায়ণের মানবিক আবেদনের জন্য এরকম ঘটনা ঘটতে পেরেছে। রামকথার মেটাফর মুক্ত আজও পৃথিবী হতে পারেনি। রামকথার বিনির্মাণ প্রতিদিন ঘটে চলেছে। রামায়ণ আজও আধুনিক পৃথিবীকে নানাভাবে প্রেরণা দেয় ও দীপ্ত করে। রামায়ণের চরিত্রগুলির আর্কেটাইপ আধুনিক সাহিত্যে। রামায়ণের চরিত্রগুলির কাহিনী আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের নানা সমস্যায়, বাদ-প্রতিবাদে প্রবহমান, ব্যবহৃত হয়। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষাও মানুষ রামায়ণ থেকে খুঁজে নিয়েছে। ভারতীয় সমাজ, ভারতীয় মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব বুঝতে হলেও রামায়ণ পাঠ অপরিহার্য। ভারতীয় অর্থনীতির মূল সুরও রামায়ণের সুরে বাঁধা। ভারতীয় পুরুষরা রামের মতো শ্রেষ্ঠ পুরুষ হতে চান, আর ভারতীয় নারীরা সীতার মতো সতী (এ নিয়ে যে বিতর্কই থাক)। বিভীষণ আজও ভারতীয় সমাজে নিন্দিত পরিভাষা—যার অর্থ বিশ্বাসঘাতক, যে ঘরের শত্রু, যে বাইরের শত্রুকে ঘরে ডেকে আনে । রামায়ণে যেমন ভক্তির প্রাবল্য আছে, ন্যায় নীতি আদর্শের কথাও আছে। সমাজ সমালোচনা আছে। রামায়ণ নিছক একটি মহাকাব্য নয়। এই মহাকাব্য অসংখ্য ও নানা বিচিত্র ধরনের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ফোয়ারার উৎসমুখ। যার শেকড় ছড়িয়ে আছে প্রতিটি ভারতীয়ের মননে। রামায়ণ নিয়ে যে কোন গবেষণা মহাসাগরের জল নিয়ে মহাসাগরের গবেষণা। মনে হয় যতদিন মানবসমাজ এই বিশ্বে টিঁকে থাকবে, রামায়ণের বিনির্মাণ অব্যাহত থাকবে। এখানে রামায়ণের সিন্ধু থেকে বিন্দু নিয়ে পাঠকদের দেওয়ার চেষ্টা হল। এও এক ধরনের রামায়ণ পাঠ, রামায়ণের পাঠকৃতি বা রামায়ণের বিনির্মাণ।