এক সিদ্ধার্থ বাড়ি থেকে বেরুতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখলো ওদের বাড়ির সামনে একটা মোটর গাড়ি থেমে আছে। সামনে ড্রাইভার, পিছনের সীটে এক ভদ্রমহিলা। ড্রাইভার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে-এ-গলির শেষ বাড়ি সিদ্ধার্থদের। ওকে জিজ্ঞেস করলো, পঁচিশের এক? পঁচিশের এক, কালীপ্রসাদ চৌধুরী, কোন্ বাড়িটা? সিদ্ধার্থ একটু ভুরু কুঁচকে বললো, এই বাড়ি- ড্রাইভার নেমে পেছনের দরজা খুলে দিল। ভদ্রমহিলা নামলেন। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মাঝামাঝি কোথাও বয়েস, ফরশা মুখে সোনার চশমা, বেশ ব্যক্তিত্বময়ী। স্পষ্টভাবে উচ্চারণ ক'রে তিনি বললেন, আমি কালীপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। তিনি বাড়ি আছেন? ছোটোকাকার সঙ্গে এ-রকম কোনো মহিলা আগে কোনোদিন দেখা করতে আসেনি। সিদ্ধার্থ কিছুটা অবাক হয়। দরজা খুলে দিয়ে বলে, আসুন, ভেতরে আসুন । দরজার পরেই বারান্দা, বারান্দার একপাশে টেবিল ও কয়েকটা চেয়ার পাতা, বাইরের কেউ এলে এখানেই বসতে হয়। চেয়ারের ওপর থেকে দোমড়ানো খবরের কাগজ সরিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, আপনি একটু বসুন, আমি ওঁকে ডেকে দিচ্ছি। সেই মুহূর্তে ছোটোকাকার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না সিদ্ধার্থর। ভেতরে ঢুকে ডাকলো, টুনু! টুনু ! সাড়া নেই, টুনু বাড়ি নেই। মা মেঝেতে চাল ছড়িয়ে কাঁকর বাছছেন। এর মধ্যে কোনো-এক ফাঁকে তিনি জানালা দিয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখে নিয়েছেন নিশ্চয়ই, কেননা সিদ্ধার্থকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে রে? কোত্থেকে এসেছেন? সিদ্ধার্থ হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলো, আমি তা কী ক'রে জানবো? আমার কাছে এসেছে নাকি? —নাম জিজ্ঞেস করিসনি?
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।