গোয়েন্দা কেদার মজুমদার ও তাঁর সহকারী বদ্রীনারায়ণ মুখার্জিকে নিয়েই ঘনশ্যাম চৌধুরীর গোয়েন্দা কেদার-বস্ত্রী রহস্য সিরিজ। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এই রহস্য কাহিনিগুলি বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। মনে হতে পারে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করেই বুঝি এই রহস্য সিরিজ। কিন্তু তা নয়। নতুন ভাবনা, নতুন দিক্চিহ্ন বহন করছে কাহিনিগুলি। নতুন যুগের বাংলা ভাষার পাঠক-পাঠিকাদের কাছে তাই ঘনশ্যাম চৌধুরীর এই সিরিজ প্রতি বছরই জনপ্রিয়তার এক একটি করে মাইলস্টোন পেরিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা কেদার বাঙালির কাছে এক আদর্শ চরিত্র। শিক্ষাদাতা, রুচি, সাহিত্যবোধেও তিনি যেমন দৃষ্টান্ত, তেমনি সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী কেদার মানসিক ও শারীরিক ভাবেও বলশালী। ফলে আপামর বাঙালির ভালোবাসার জন হয়ে উঠেছেন তিনি। ব্ল্যাক বেল্ট ক্যারাটে মাস্টার, দুঃসাহসী কেদারের কাছে বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারবিহীন জীবন একেবারেই পানসে লাগে। রহস্য সমাধানে, দুর্বৃত্ত মোকাবিলায় কেদার-বদ্রী দু'জনেই মগজের খেলাকেই প্রাধান্য দেন। একটাও গুলি খরচ করতে চান না। রহস্য সমাধানে বদ্রীনারায়ণ কেদারের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে পরিপূর্ণ আধুনিকতা নিয়ে এসেছে বদ্রীনারায়ণ চরিত্রটি। সুনির্দিষ্ট অনুভূতি, চিন্তা অথবা পুরনো ঘটনার স্মৃতি, মানুষের চরিত্ররহস্য— এসব বদ্রীকে ভাবায়। বদ্রীর মন তোলপাড় হয়ে ওঠে। যখন ওর চিন্তাস্তরে রহস্যের কোনো বিষয় ঢুকে পড়ে, তখনই বদ্রীর মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। শুরু হয় অবচেতন মনের খেলা। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে কোনো 'সুপারম্যান' জাতীয় চরিত্র আজও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সেক্ষেত্রে বদ্রীনারায়ণ নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে অদ্ভুত রকমের মানসিক শক্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে। তার নীলাভ চোখের ঘূর্ণায়মান মণিদু'টি সেই শক্তিরই আধার। আগামী দিনগুলোয় কেদার-বস্ত্রীর রহস্য কাহিনিগুলিতে সেই রহস্য-শক্তি আরো বিকশিত হবে।
ঘনশ্যাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১লা অক্টোবর। কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব থেকে কিশােরকাল কেটেছে হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায়। লেখকের পরিবারের আদি নিবাস অখণ্ড বাংলার । ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজানগর গ্রামে। অবিন্যস্ত জীবনে ঘনশ্যাম চৌধুরীর পড়াশােনা গুপ্তিপাড়ার মীরডাঙা প্রাইমারি স্কুল, গুপ্তিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, পরে উত্তর কলকাতার সারদাচরণ এরিয়ান ইনস্টিটিউশন এবং তারও পরে বর্ধমান জেলার পূর্ব সাতগাছিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পারিবারিক কারণেই তার পড়াশােনার মাঝে মাঝে ছেদ ঘটে ও স্কুল বদল করতে হয়। পড়াশােনা চলাকালীনই চলতে থাকে জীবনসংগ্রাম। কলকাতায় বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশােনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। এম এ পাশ করার পর লেখক একটি বিশিষ্ট বাংলা দৈনিকে সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত হন। তখন থেকেই তার জীবনপ্রবাহ অন্যদিকে মােড় নেয়। এরপর শুধুই বড়দের নয়, শিশু-কিশােরদের জন্যও লিখতে শুরু করেন ঘনশ্যাম চৌধুরী। গােয়েন্দা রহস্য কাহিনি ছাড়াও তিনি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, রূপকথার গল্প লিখে সমসময়ের সাহিত্যে অন্য স্বাদ নিয়ে আসতে পেরেছেন। তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘অবগাহন’ মল্লভূম পুরস্কার পায়। পুণ্যিবালা গল্প সংকলনের ‘পুণ্যিবালা’ গল্প অবলম্বনে বেতার নাটক। আকাশবাণীর সর্বভারতীয় প্রথম পুরস্কার পায় ২০০৪ সালে। বাংলাদেশের ঢাকা থেকেও তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা ছােটদের বই রূপকথার ঝাপি, সােনারঙের দিন, আনন্দ রূপকথা। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়লাখনি অঞ্চলের জীবন নিয়ে তার দু’টি গল্প সংকলনে ব্রাত্য মানুষজনের। প্রতি লেখকের অকৃত্রিম দরদ উপলব্ধি করা যায়।