ঘনশ্যাম চৌধুরীর গোয়েন্দা অ্যাডভেঞ্চার সিরিজের প্রধান দুই চরিত্র কেদার মজুমদার এবং বদ্রীনারায়ণ মুখার্জি একের পর এক জনপ্রিয়তার মাইলস্টোন পেরিয়ে যাচ্ছে। আপাদমাথা বাঙালি গোয়েন্দা কেদার একজন আদর্শ পুরুষ শুধু তাই-ই নন, তিনি বাংলার ঘরের মানুষ, একান্ত প্রিয়জন। তিনি ঘরে ঘরে, বাংলার সর্বত্র, গ্রামে-গঞ্জে, বাচ্চা-বুড়ো সবার এত আপন হলেন কী করে? তিনি যতই কঠিন কঠিন রহস্যের সমাধান করুন, এই ব্যাপারে অন্তত কোনো রহস্যই নেই। কেন না, আরও দশটা বাঙালির মতোই জীবনযাপন করেন তিনি। বেশ ভোজনরসিক, যাকে বলে পেটুক, কেদার হচ্ছেন তাই। উচ্চ শিক্ষিত কেদারের শিল্প-সাহিত্যবোধ, কবিতার প্রতি আসক্তি বাঙালি পছন্দ করবেই। কার্যত তাই হয়েছে। অন্যদিকে কেদার যেখানে যতই ইংরিজি খানা খান না কেন, আসলে তাঁর প্রিয় খাবার হল লাউ চিংড়ি, শুক্তো, কলমি শাক, কচু, পালং, উচ্ছে ভাজা, মুগের ডাল কিংবা পোস্ত ইলিশ ভাপা। মোচার ঘণ্ট, সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি, পেঁয়াজকলি ভাজা, এমনকী সাদামাটা আলু পটলের ঝোল কেদারের পছন্দের মধ্যেই পড়ে। পাড়ার গলির গোপালদার দোকানের লিকার চা, খাস্তা লোকাল বিস্কুট, পাঁউরুটিটোস্ট না হলে কেদার-বদ্রীর মেজাজই আসে না। এমন খাঁটি বাঙালিকে আপামর বাঙালি কাছে টেনে নেবেনই। তবে এও মনে রাখতে হবে, ব্ল্যাক বেল্ট ক্যারাটে মাস্টার, দুঃসাহসী কেদার বিপজ্জনক কাজে, রহস্য সমাধানে সিদ্ধহস্ত। যেমন সুগঠিত তাঁর স্বাস্থ্য, তেমনই তিনি মানসিক শক্তির অধিকারী। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে অন্য মাত্রা এনেছে কেদারের সহকারী বদ্রীনারায়ণও। নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে সুপার পাওয়ার হিসাবে উঠে আসছে বদ্রী। বিপদের মুখে, কঠিন রহস্যময় ঘটনার সামনে দাঁড়ালেই তাঁর অবচেতন সত্তা জেগে ওঠে। তাঁর নীল চোখের মণিতে অদ্ভুত আলোর রোশনাই দেখা যায়। তার অবচেতন মনে আপরাধের সূত্র ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সুদূর নক্ষত্রলোকের সঙ্গে তার অলৌকিক যোগাযোগের কথা আমরা জানতে পারব।
ঘনশ্যাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১লা অক্টোবর। কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব থেকে কিশােরকাল কেটেছে হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায়। লেখকের পরিবারের আদি নিবাস অখণ্ড বাংলার । ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজানগর গ্রামে। অবিন্যস্ত জীবনে ঘনশ্যাম চৌধুরীর পড়াশােনা গুপ্তিপাড়ার মীরডাঙা প্রাইমারি স্কুল, গুপ্তিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, পরে উত্তর কলকাতার সারদাচরণ এরিয়ান ইনস্টিটিউশন এবং তারও পরে বর্ধমান জেলার পূর্ব সাতগাছিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পারিবারিক কারণেই তার পড়াশােনার মাঝে মাঝে ছেদ ঘটে ও স্কুল বদল করতে হয়। পড়াশােনা চলাকালীনই চলতে থাকে জীবনসংগ্রাম। কলকাতায় বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশােনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। এম এ পাশ করার পর লেখক একটি বিশিষ্ট বাংলা দৈনিকে সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত হন। তখন থেকেই তার জীবনপ্রবাহ অন্যদিকে মােড় নেয়। এরপর শুধুই বড়দের নয়, শিশু-কিশােরদের জন্যও লিখতে শুরু করেন ঘনশ্যাম চৌধুরী। গােয়েন্দা রহস্য কাহিনি ছাড়াও তিনি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, রূপকথার গল্প লিখে সমসময়ের সাহিত্যে অন্য স্বাদ নিয়ে আসতে পেরেছেন। তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘অবগাহন’ মল্লভূম পুরস্কার পায়। পুণ্যিবালা গল্প সংকলনের ‘পুণ্যিবালা’ গল্প অবলম্বনে বেতার নাটক। আকাশবাণীর সর্বভারতীয় প্রথম পুরস্কার পায় ২০০৪ সালে। বাংলাদেশের ঢাকা থেকেও তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা ছােটদের বই রূপকথার ঝাপি, সােনারঙের দিন, আনন্দ রূপকথা। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়লাখনি অঞ্চলের জীবন নিয়ে তার দু’টি গল্প সংকলনে ব্রাত্য মানুষজনের। প্রতি লেখকের অকৃত্রিম দরদ উপলব্ধি করা যায়।