"দেনা-পাওনা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘দেনা-পাওনা' (১৯২৩) উপন্যাসটি শরৎচন্দ্রের অন্যান্য গ্রন্থ হইতে অনেকটা ভিন্নজাতীয়। নিজ বিবাহিত পরিত্যক্ত স্ত্রী, অধুনা চণ্ডীগড়ের ভৈরবী ষােড়শীর সংস্পর্শে, অত্যাচারী, লম্পট, পাপপুণ্যজ্ঞানহীন জমিদার জীবানন্দের অভূতপূর্ব পরিবর্তন এই উপন্যাসটির মূল বিষয়। দারুণ কুক্ৰিয়াসক্ত, পাপপঙ্কে আকণ্ঠ-নিমগ্ন জীবানন্দের অন্তরে যে প্রণয়প্রবৃত্তি ও ভদ্রজীবনযাপনের স্পৃহা সুপ্ত ছিল তাহা ষােড়শী-সংসর্গের মায়াদণ্ডস্পর্শে অকস্মাৎ নবজীবন লাভ করিয়া ফুলে-ফলে মঞ্জরিত হইয়া উঠিল। ষােড়শীর চরিত্র-গৌরবের অসাধারণত্ব বুঝাইবার জন্য লেখক দেবীমন্দিরের ভৈরবীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে যে বিশেষ ধর্মসংস্কার প্রচলিত আছে, তাহার প্রতি আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করিয়াছেন। এই ভৈরবীদের বাহ্য কৃচ্ছসাধন ও আত্মনিগ্রহের অন্তরালে একটা কুৎসিত ভােগলালসার উজ্জ্বলতা প্রায় প্রকাশ্যভাবেই অভিনীত, ইহা, ভৈরবী-জীবনের একটা বিশেষত্ব। এই কদাচার শাস্ত্রবিধি অনুসারে গর্হিত হইলেও প্রকৃত প্রস্তাবে উপেক্ষিত হইয়া থাকে- ইহাদের চরিত্রভ্রংশ একটা অবশ্যম্ভাবী অপরাধের ন্যায় একটু বিদ্রুপ-মিশ্রিত উপেক্ষার চক্ষেই সকলে দেখিয়া থাকে। কিন্তু প্রয়ােজন হইলে এই উপেক্ষিত অপরাধ হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত গুরুত্ব লাভ করে ও আমাদের সামাজিক দলাদলির আগুন জ্বালাইতে ইন্ধনের কাজ করে। এখানে ষােড়শী সম্বন্ধে ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। তাহার কল্পিত অপরাধের দণ্ড প্রদান করিতে আমাদের সমাজপতিরা হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তাহার দেবীর সেবাইত-পদের জন্য অযােগ্যতার বিষয়ে তাঁহাদের সুপ্ত বিবেকবুদ্ধি হঠাৎ অতিমাত্রায় জাগরিত হইয়া উঠিয়াছে- বিশেষত যখন এই ধর্মানুষ্ঠানের পুরস্কার, মন্দিরের সম্পত্তি ও দেবীর বহুকাল-সঞ্চিত অলংকারাদির সদ্য-লাভ। ধর্মজ্ঞানের পশ্চাতে যখন বিষয়স্পৃহা ঠেলা দেয় তখন তাহার বেগ অনিবার্য হইয়া থাকে। সুতরাং এই ধর্মপ্রাণ সমাজের সমস্ত সম্মিলিত শক্তি যে অতি নির্মমভাবে একটি অসহায়া রমণীর উপর গিয়া পড়িবে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। ষােড়শীর চরিত্রের প্রকৃত গৌরব এই যে, পাপপথে পদার্পণের জন্য পূর্ববর্তিনীদের নজির ও সমাজের প্রায় অবাধ সনন্দ দেওয়া থাকিলেও তাহার সহজ ধর্মবুদ্ধি তাহাকে সেই সনাতন পথে পা বাড়াইতে দেয় নাই। তাহার পর মন্দিরের সম্পত্তির অধিকারিণী বলিয়া ও পূজাসংক্রান্ত কার্যে সর্বদা পুরুষের সহিত সংস্রবের প্রয়ােজন থাকায় ষােড়শীর চরিত্রে অনেক পুরুষােচিত গুণের বিকাশ হইয়াছে- বিপদে স্থিরবুদ্ধি, অচঞ্চল সাহস ও একান্ত আত্মনির্ভরশীল একটা দুর্ভেদ্য নিঃসঙ্গতার সহিত রমণীসুলভ কোমলতা মিশিয়া তাহার চরিত্রকে অপূর্ব মাধুর্যে ও গাম্ভীর্যে মণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছে। এই অপূর্ব চরিত্রই জীবানন্দকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করিয়া তাহার পাষাণ প্রাণকে দ্রবীভূত করিয়াছে ও তাহাকে প্রথম প্রণয়ের স্বাদ দিয়াছে। জীবানন্দের অসংকোচ পাপানুষ্ঠানের মধ্যে অন্তত লুকোচুরির হীন কাপুরুষতা ছিল না, এবং এই সত্যভাষণের পৌরুষ ও কপটাচারের প্রতি অবজ্ঞাই তাহার চরিত্রে মহত্ত্বের বীজ; প্রেমের স্পর্শে ইহা একটি অকপট অনুতাপ ও সংশােধনের দৃঢ় সংকল্পরূপে আত্মপ্রকাশ করিল। তাহার মনে প্রেমের অলক্ষিত সঞ্চার, তাহার পক্ষে একান্ত অভিনব দ্বিধা-সংকোচ-জড়িত অন্তর্দ্বন্দ্ব অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত হইয়াছে। গ্রাম্য সমাজপতিদের চরিত্রও অল্প কয়েকটি কথায় বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। তবে নির্মল-হৈমবতীর আখ্যান মূল গল্পের সহিত নিবিড় ঐক্য লাভ করে নাই। ফকির সাহেবেরও উপন্যাসে বিশেষ কোনাে সার্থকতা নাই। তিনি বাস্তবতা-প্রধান যুগে আদর্শবাদপ্রিয়তার শেষ চিহ্নস্বরূপই প্রতীয়মান হন। ভৈরবী-জীবনের লৌকিক আচার-ব্যবহারগত বিশেষত্বই এই উপন্যাসের বৈচিত্র্যের হেতু হইয়াছে এবং এই ভিত্তির উপরই শরৎচন্দ্র ষােড়শীচরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। নির্মল ও হৈমর দাম্পত্য-জীবনের দৃষ্টান্ত ষােড়শীর মনে সংসার বাঁধিবার বাসনাকে উদ্ৰিক্ত করিয়া তাহার জীবনের ভবিষ্যৎ পরিণতির হেতুস্বরূপ হইয়াছে। এবং উপন্যাস-মধ্যে এই খণ্ড-কাহিনীর প্রবর্তনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইহাই-এইরূপ অভিমত অনেক সমালােচক কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে। হয়তাে ষােড়শী যখন নবােম্মুেষিত স্বামিপ্রেমে কিছুটা উন্মনা ও চলচ্চিত্ত হইয়া পড়িয়াছে, যখন তাহার ভৈরবী-জীবনের আদর্শ ও সংস্কার এই প্রণয়াকাক্ষার প্রাবল্যে কতকটা শিথিল হইয়াছে মনের সেই দোদুল অবস্থায় হৈমর দাম্পত্য-জীবনের নিরুদ্বেগ সুখ-শান্তি তাহাকে খানিকটা স্পর্শ করিয়া থাকিবে। বিশেষত সমাজের সম্মিলিত বিরুদ্ধতার মধ্যে একমাত্র হৈমর হিতৈষণা ও সমবেদনা তাহাকে হৈমর জীবনাদর্শের প্রতি কতকটা আকৃষ্ট করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু সমস্ত বিষয়টি অভিনিবেশ সহকারে আলােচনা করিলে এই অভিমতকে যথার্থ বলিয়া মনে হয় না। প্রথমত, ষােড়শীর চিত্তে স্বামিপ্রেম-সঞ্চার হৈমর সহিত পরিচয়ের পূর্বেই ঘটিয়াছে। দ্বিতীয়ত, ষােড়শীর স্বচ্ছদৃষ্টির ও তীক্ষ অনুভূতির নিকট হৈমর তথাকথিত দাম্পত্য-প্রেমসৌভাগ্যের অন্তঃসারশূন্যতা গােপন থাকে নাই। যে নির্মল তাহার প্রণয়ের লােভে ঘন ঘন তাহার সঙ্গে সাক্ষাতের অবসর খাজে, দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রচুর আশ্বাসের বারিসেকে তাহার মনে প্রণয়ের বীজটি অঙ্কুরিত করিয়া তুলিতে চাহে, হৈমকে ফাঁকি দিয়া যে রঙিন আবেশটিকে ঘনীভূত করার স্বপ্ন দেখে সেই নির্মলকে অংশীদাররূপে লইয়া যে প্রেমের কারবার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তাহার বাহিরের বিজ্ঞাপনের চটক ড়েও অন্তরে যে তাহা দেউলিয়া এ সত্য ষােড়শীর নিকট নিশ্চয় দিবালােকের মতাে স্বচ্ছ হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং হৈম-নির্মলের দাম্পত্য-জীবনে যে ষােড়শীর লােভ করিবার মতাে বিশেষ কিছু ছিল ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। তৃতীয়ত, ষােড়শীর আত্মনির্ভরশীল, বলিষ্ঠ প্রকৃতির উপর 'অপরের জীবনের প্রভাব যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হইবে ইহাও সম্ভব মনে হয় না। বহুকালবিস্মৃত প্রথম কৈশােরের মুগ্ধ প্রণয়াবেশের স্মারক অলকা নামটি যে তাহার দীর্ঘদিনরুদ্ধ প্রেমের কপাটটিকে যেন মন্ত্রবলে উন্মুক্ত করিয়াছে ইহাও তাহার অনন্যনির্ভর স্বাধীনচিত্ততারই নিদর্শন। এই নামমাধুর্যের অসাধ্যসাধনের কৃতিত্ব পরের নিকট ধার-করা প্রভাবের সাহায্য গ্রহণের দ্বারা নিশ্চয়ই খণ্ডিত ও ক্ষুন্ন হয় নাই। তাছাড়া, উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস আলােচনা করিলেও ইহা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, হৈমর প্রতি এতটা গুরুত্ব-আরােপ লেখকের অভিপ্রেত ছিল না- উহাকে উপন্যাসের একটি প্রধান নিয়ামক-শক্তিরূপে লেখক কল্পনা করেন নাই। হৈমর দৃষ্টান্তে যদি ষােড়শীর সংসার পাতিবার ইচ্ছা জাগ্রত হইয়া থাকে, তবে ফকির সাহেবের প্রভাবে তাহার মনে বৈরাগ্যের প্রেরণা প্রবলতর ইহয়াছে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, কিন্তু তাহার ভৈরবীত্বই তাহার বৈরাগ্য-মন্ত্রে দীক্ষার মূল উৎস। আসল কথা, হৈমর দাম্পত্য-প্রেম ও ফকির সাহেবের সেবাধর্ম ও সংসার-বন্ধনহীন নির্লিপ্ততা এই দুই একই পর্যায়ের প্রভাব; ইহা হয়তাে বাহির হইতে ষােড়শীর অন্তর্দ্বন্দ্বমথিত জীবনের দুই বিপরীতমুখী আবেগকে কতকটা সমর্থন করিয়াছে, কিন্তু তাহার অন্তরে প্রবেশ করিয়া তাহার প্রেরণার মূল রহস্যের সহিত একাঙ্গীভূত হয় নাই। যাহার অন্তরে ধ্রুবতারার অনির্বাণ জ্যোতি, তাহাকে পথিপার্শ্বস্থ গৃহপ্রদীপ যাত্রাপথে খানিকটা আলোেক বিকিরণ করিতে পারে, কিন্তু ইহা তাহার পথনির্দেশের গৌরব দাবি করিতে পারে না। | বঙ্গ-উপন্যাস-ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র যে কতটা স্থান অধিকার করিয়া আছেন, কীরূপ বিরাট শূন্যতা পূর্ণ করিয়াছেন তাহার সম্যক পরিচয় দেওয়া সহজ নহে। বঙ্কিম উপন্যাসের জন্য যে নূতন পথ প্রবর্তন করিয়াছিলেন তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সেই পথ অবরুদ্ধপ্রায় হইয়া পড়িয়াছিল। ঐতিহাসিক উপন্যাস তাে একেবারেই লােপ পাইয়াছিল; সামাজিক উপন্যাসও তাঁহার গৌরবও অর্থগভীরতা হারাইয়াছিল । রবীন্দ্রনাথ এই অবরুদ্ধ পথ কতকটা মুক্ত করিলেন বটে, কিন্তু এই বাধা অতিক্রম করিতে তিনি যে নূতন প্রণালী অবলম্বন করিলেন তাহা যেমনই বিস্ময়কর তেমনি অননুকরণীয়। তাঁহার কবি-কল্পনার মুক্ত পক্ষ আশ্রয় করিয়াই তিনি উপন্যাসের পথের এই পাষাণ-প্রাচীন উল্লঙ্ঘন করিলেন। যে কবিত্বশক্তি সামান্যের মধ্যে অসামান্যের সন্ধান পায়, প্রকৃতির মধ্যে মানব-মনের উপর নিগূঢ় প্রভাবের রহস্য খুঁজিয়া বেড়ায়, তাহার দ্বারাই তিনি উপন্যাসের বিষয়গত অকিঞ্চিৎকরত্ব অতিক্রম ও রূপান্তরিত করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার প্রবর্তিত পথে তাঁহার পরবর্তীদের পদচিহ্ন নিতান্তই বিরল; তাহার কবি-প্রতিভা না থাকিলে। তাহার অনুসরণ অসম্ভব। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের উপর তাহার প্রতিভার ছাপ মারিয়াছেন সত্য, কিন্তু তাহার পরিধি ও প্রসার বিশেষ বৃদ্ধি করেন নাই। এই অবসরে শরৎচন্দ্র অবতীর্ণ হইয়া বাংলা উপন্যাসের সমৃদ্ধির নূতন পথ নির্দেশ করিয়াছেন। তিনি কবিত্বশক্তির অধিকারী না হইয়াও কেবল সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি, চিন্তাশীলতা ও করুণরসসৃজনে সিদ্ধহস্ততার গুণে বঙ্গ-সমাজের কঠিন, অনুর্বর মৃত্তিকা হইতে নূতন রসের উৎস বাহির করিয়াছেন ও উপন্যাসের ভবিষ্যৎ গতির পথরেখা বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করিয়াছেন। তিনি আমাদের পারিবারিক জীবনে অকিঞ্চিৎকর বাহ্য ঘটনার মধ্যে গূঢ় ভাবের লীলা দেখাইয়াছেন; আমাদের নারী-চরিত্রের জড়তা ও নির্জীবতা ঘুচাইয়া তাহার দৃপ্ত তেজস্বিতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির পরিচয় দিয়াছেন। তিনি আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার বৈষম্য ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করিয়া একসঙ্গে স্বাধীন চিন্তা ও করুণরসের উৎস খুলিয়া দিয়াছেন, এই আত্মপীড়ননিরত জাতির ভগবদ্দত্ত দুঃখ যে নিজ মূঢ়তায় কত বাড়িয়াছে তাহা দেখাইয়াছেন। সর্বশেষে তিনি প্রেম-বিশ্লেষণের দ্বারা প্রেমের রহস্যময় গতি ও প্রকতির উপর। নূতন আলােকপাত করিয়াছেন। সৃষ্টিশক্তির এই অদ্ভুত পরিচয়-দানের পর তাঁহার প্রতিভাতে ক্লান্তির লক্ষণ দেখা দিয়াছে; এবং উপন্যাস-সাহিত্যের আকাশে আবার অনিশ্চয়তার আঁধার ঘনাইয়া আসিতেছে বলিয়া মনে হয়। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, এ অনিশ্চয়তার কুহেলিকা যখন কাটিয়া যাইবে ও অগ্রগতির প্রেরণা যখন আবার গতিবেগ আহরণ করিবে তখন ইহা শরৎচন্দ্রের নির্দিষ্ট পথ ধরিয়াই অগ্রসর হইয়া যাইবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, শরৎচন্দ্রই আমাদের ভবিষ্যৎ উপন্যাসের গতিনিয়ামক হইবেন।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।