মিনিবাস থেমে নেমে জায়গাটা মোটেই পছন্দ হল না ভাস্করের। বাঁদিকটা মিনি বড়বাজার, সামনে গাড়ির জট পাকানো আবহাওয়া। ডানদিকে তাকালে একটা খেলার মাঠ দেখা যায় বটে তবে সেটা অযত্নে রাখা। খানিকটা নিচে পাহাড় কেটে বড় মাঠ তৈরি যিনি করেছিলেন তাঁর চেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর বাসনা এখনকার কারও নেই। চারপাশের বাড়িঘর দোকনপাটও খুব পুরনো চেহারার। অথচ সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে কালিঝোরা বাংলোকে রেখে উঠে আসবার সময় থেকেই মন প্রফুল্ল হচ্ছিল। এদিকে কখনই আসা হয়নি ভাস্করের। ডানদিকে খরস্রোতা তিস্তা আর চমৎকার ঝিমধরা পাহাড় দেখতে দেখতে বারংবার মনে হচ্ছিল দার্জিলিংয়ের পথের চেয়ে এর চেহারা- চরিত্র আলাদা। অথচ বাসটার্মিনাসে নামার পর তার মন খারাপ হয়ে গেল। একটা ঘিঞ্জি এলাকা ছাড়া কিছু ভাবা যাচ্ছে না। কিন্তু শীত পড়েছে জব্বর। এখন কলকাতায় ঘাম ঝরছে আর এখানে মনে হচ্ছে স্লিভের বদলে পুরোহাতা কিছু থাকলে ভাল হত। আর বিকেল তিনটেয় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সন্ধের পর ঘরের বাইরে পা দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মিনিবাসের ছাদ থেকে মালপত্র নামানো হলে ভাস্কর তার সুটকেস তুলে নিল। তিনটে লোক ছুটে এসেছিল মাল বইবার জন্যে কিন্তু ভাস্কর তাদের হঠিয়ে দিল। ভাস্কর জানে সে বিরক্তিভরে কিছু বললে যারা জ্বালাতন করতে আসে তারা সব সরে যায়। হয়তো তার চেহারা এবং কন্ঠস্বরে এমন একটা ব্যাপার আছে-কোনও দালাল বা পাণ্ডা তাকে ঘাঁটাতে চায় না।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।