'পশ্চিমের, গঙ্গার দিকের দরজা দিয়ে নরেন্দ্র প্রথম দিন (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের পৌষ মাস) এই ঘরে (দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘর) ঢুকেছিল। দেখলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও বেশভূষার কোনও পারিপাট্য নাই, বাইরের কোনো পদার্থে ইতরসাধারণের মতো আঁট নাই, সবই যেন তার আলাদা। চোখ দেখে মনে হল, তার মনের অনেকটা কে ভেতরের দিকে জোর করে টেনে রেখেছে। দেখে মনে হল, বিষয়ী লোকের আবাস কলকাতায় এতবড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব।'
মেঝেতে মাদুর পাতা ছিল। আঠারো বছরের তরতাজা যুবক, কলেজের ছাত্র নরেন্দ্রনাথ বসলেন। ঠাকুরের বয়েস তখন ৪৫ বছর। তখন কে জানত এমন হবে। একটি মহাজীবনে আর একটি মহাজীবনের প্রবেশ। অজানা লোকে করতালি। সময় যেন গর্ভবতী হল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের হাতে আর মাত্র পাঁচটি পার্থিব বছর।
কোনো কথা নয় । একটি গান— 'মন চল নিজ নিকেতনে। পৌষ মাস। মৃদু শীত, গঙ্গার বাতাস, পাতার শব্দ । বাকি সব শান্ত প্রশান্ত নিস্তব্ধ। মহাসময় এই সমাধিকে দেখছে। ইতিহাসের জন্মলগ্ন। শক্তির আধারে আর একটি উৎসমুখ খুলছে। ঠাকুরের ঘরের উত্তরে সেই ঐতিহাসিক বারান্দা। সেখানে আজও থমকে আছে এই সময়, এই চিত্রটি শিষ্য নরেন্দ্র বিস্ময়, বিমূঢ়। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে দণ্ডায়মান গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। করজোড়ে বলছেন, ‘এত দিন পরে আসতে হয়', আমি তোমার জন্যে কিরূপ অপেক্ষা করে আছি তা একবার ভাবতে নেই!' শ্রীরামকৃষ্ণের দুচোখে জলের ধারা। তিনি অদ্ভুত সব কথা বলছেন, “তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে আবার শরীর ধারণ করেছ।”
নির্ভীক নরেন্দ্রনাথ সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি কি ঈশ্বরদর্শন করেছেন?' সুস্পষ্ট উত্তর, 'করেছি, তোমাকেও করাতে পারি।' স্পর্শ মাত্রে নরেন্দ্রনাথ উঠে গেলেন অনন্তে। ভয় পেলেন। প্রস্তুত ছিলেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, দেখে রাখো। এসব হবে পরে। জেনে রাখ প্রকাণ্ড এই জগৎকাণ্ড। ক্ষুদ্র মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামে পাশে দাঁড়াও। ঈশ্বর একটি নর বহু। বহুর মাঝে সেই এককে খোঁজো। যত্র জীব তত্র শিব। ঈশ্বরকে খুঁজতে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ মানুষকে খুঁজে পেলেন। বললেন ‘তোমরা ভুল করে যাকে মানুষ বলো আমি তাকেই ভগবান বলি।' ঠাকুর তাঁকে অশেষ করে দিয়ে গেছেন। শেষ কথা কে বলবে!
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক। তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং হুগলী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহন করেন । তিনি অনেক উপন্যাস,ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন । তাঁর সবথেকে বিখ্যাত উপন্যাস লোটাকম্বল যা দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচনায় হাস্যরসের সাথে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ মেশানো থাকে ।ছোটদের জন্য তাঁর লেখাগুলিও খুবই জনপ্রিয় । তাঁর সৃষ্ট ছোটদের চরিত্রের মধ্যে বড়মামা ও ছোটমামা প্রধান ।