মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর দুই দশক পর তাঁর ডাইরি চিঠিপত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিগত লেখার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণিক সংকলন ‘অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : ডায়েরি ও চিঠিপত্র'। বাংলা ভাষায় এই প্রথম প্রকাশিত হল একজন লেখকের এ-জাতীয় যাবতীয় ব্যাক্তিগত কাগজপত্র। এই সমস্ত রচনার মধ্যেই ধরা আছে তাঁর জীবন ও সাহিত্যচর্চার অতিব্যক্তিগত বিবরণ—লেখক ও মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক সংকট ও সংকল্প, তাঁর গোপন ও প্রকাশ্য জীবনের অনেক দ্বন্দ্বময় ইতিহাস। সন্দেহ নেই, তিনিই আমাদের সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান ‘আধুনিক’ ঔপন্যাসিক, যদিও তাঁর আধুনিকতার তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক অবস্থান এখনও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়নি— মৃত্যুর পর এতগুলি বছর একাদিক্রমে যিনি আমাদেরই সমসাময়িক, অথচ এখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম যাঁদের ধারাবাহিক অনুশীলনের বিষয়, তাঁদের মনে হতে বাধ্য যে তাঁর প্রকাশিত রচনার মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হননি। তাই সমগ্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় উদ্ধারে তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত লেখা আজ অপরিহার্য মনে হয়। বর্তমান সংকলনে লেখকের সেই সমগ্র ব্যক্তিত্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। প্রথাগত গবেষণার বাইরে যা মৌলিক ও প্রকৃত অর্থে সাহিত্য-সম্পর্কিত কাজ, বর্তমান গ্রন্থের সামগ্রিক সম্পাদনা-কৰ্ম সেই ঐতিহ্যে এক নতুন আদর্শ স্থাপন করবে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।