বহুল সাংকৃত্যায়নের পর্যটনময় জীবনের এই পৃষ্ঠাগুলি অন্য এক চেতনায় দীপ্যমান। এখানে সেই ভয়ঙ্কর তিব্বত নেই, নেই ছদ্মবেশ, অন্তরীণ-মুহূর্ত কিংবা দুর্গম ভূখণ্ড থেকে পুঁথি উদ্ধারের মতো কালজয়ী কীর্তি। সময়ের হিসেবে এই খণ্ডটিতে তেমন কোনো বৃহৎ কালপর্বকে গ্রন্থিত করা হয়নি। ১৯৪৪-এর শেষ থেকে ১৯৪৭-এর দ্বিতীয়ার্ধ। তা সত্ত্বেও রাহুলের সমগ্র জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এই খণ্ডটি কেবল অসীম গুরুত্বপূর্ণই নয়, তা অনতিক্রম্যও। এখানে আছে, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ নিয়ে রাহুলের রাশিয়া-যাত্রা। ইরান-তেহরানের এক বিস্মৃত পটভূমি ও তেহরানে স্মরণীয় কয়েকটি মাসের অবস্থান। রাহুল সাংকৃত্যায়নের এই রাশিয়া-যাত্রা এমন একটা সময়ে, যখন বিশ্বরাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে, পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ছে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে। বিদেশের মাটিতে স্বদেশের সংবাদ শোনার জন্য উৎকণ্ঠিত রাহুল। একদিকে এই উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে এতদিনের অর্জিত জ্ঞান ও মনীষাকে উদারচিত্তে বিতরণ করার নিরলস প্রয়াস। এখানেও রাহুলের অবসর যাপিত হয় দেশ ও মানুষ দর্শনে। এখানে সমাজ, সরকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি একান্তে যেভাবে বিশ্লেষিত হয়, তা আজ সত্যিই এক দুষ্প্রাপ্য ইতিহাস। কেবল বিশ্ববীক্ষা ও মনীষাসম্পন্ন রাহুলই নয়, এই খণ্ডে আছেন এক গৃহস্থ রাহুলও। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এক সংসারী রাহুল। শেষমেশ সেখানে ও তাঁর সীমানা রচিত হয় নি। সীমানা রচনা ও অবলুপ্তির মাধ্যমেই তিনি যেন জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠেন। রাহুল ফিরে আসেন স্বদেশের মাটিতে। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, যখন, ভারতবর্ষের হাওয়ায় মর্মরিত স্বাধীনতার গান। উড়ছে তেরঙ্গা পতাকা।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।