“মিসির আলি অমনিবাস” বইয়ের ভূমিকা মিসির আলি আমাদের কেন আকর্ষণ করে? জবাবটা জিভের ডগায় এসেও আটকে যায় সহজ মনে হলেও এক কথায় চট করে বল। যায় না। মিসির আলির শুরু ১৯৮৫ সালে। "দেবী' থেকে "যখন নামিবে আধার"। সাতাশ বছরের পথপরিক্রমা মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা মাত্র। এ সময়ের মধ্যে প্যারানরমাল সাইকোলজির এই শিক্ষক মানুষটিকে বিচিত্র সব ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছে। মনোজগতের জটিল ক্রিয়াকে সরল করে তুলে ধরেছেন, ব্যাখ্যার অতীত বিষয়বস্তুকেও ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। কখনো কখনো তাকে বিচরণ করতে হয়েছে সমান্তরাল জীবন (Parallel life)-এর মধ্যে দিয়েও। অতি সাধারণ একজন মানুষের মতো জীবনযাপন করেও তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ আলোর মধ্যে থেকেও আলো-আঁধারে ঘেরা, দেখা যায় তো যায়। না, চেনাও যায় না পুরোপুরি; অনেকটা নিজেকে যেন আড়াল করে। রাখা। তবুও আমরা তার জন্য অনুভব করি—এই সংসারেরই একজন তিনি। মিসির আলির পথপরিক্রমা যেন জীবনানন্দের কবিতা- হাজার বছর ধরে আমি পথ হটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সাতাশ বছরে মিসির আলি আমাদের মনোজগতের অলিগলিতে যাতায়াত করেছেন অনেকবার। কখনো কখনো আবার রহস্যের ঘোলাজলে হারিয়েও গেছেন। মিসির আলির কাহিনীগুলো কোন ধারার? রহস্য, ডিটেকটিভ না ফ্যান্টাসি? মিসির আলির ভিন্ন মাত্রার অভিযাত্রাকে সম্ভবত ‘মিসির আলি ধারা’ নামকরণ করা যায়। যে গভীর মমতায়, মানবিক গুণাবলির সঙ্গে রহস্যময়তাকে মিশেল দেয়া হয়েছে তা বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। এরকম ঘটে নি আর ঘটবেও না। বিদায় মিসির আলি। মিসির আলি যেন 'ক্লান্ত প্ৰাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন… ফুরায় এ জীবনের লেনদেন...।’ মিসির আলি দীর্ঘজীবী হোক।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।