ভূমিকা উনিশ শতকের শুরুতে বাংলা সাহিত্যে মুদ্রণ আর গদ্য এল হাত-ধরাধরি করে। এল সাময়িকপত্র । সমাজের মধ্যে আলোচনা-ক্ষেত্রের বিস্তার ঘটল। রাজদরবার কিংবা পণ্ডিত-মহল শুধু নয়, যে-কোনো সাক্ষর বাঙালি সে-আলোচনায় শামিল হতে পারল। কিন্তু সাক্ষর নয় যারা, জনসমাজের তেমন একটা বড়ো অংশই ছিল সে আলোচনা-জগতের বাইরে। সেই বড়ো অংশের মধ্যে আছে ইতর সাধারণ আর আছে মেয়েরা। যে ন্যায়সূত্রে সংস্কৃত নাটকে প্রাকৃত ভাষায় সংলাপ লেখা হয়েছে শূদ্রের আর নারীর, তারই পরম্পরা চলে এসেছে উনিশ শতক পর্যন্ত । যে পুরুষরা সাক্ষর ছিলেন না উনিশ শতকে, তাঁদের জীবন-পরিবেশে লেখাপড়া শেখার সুযোগের অভাব ছিল নানা কারণে। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব শুধু নয়, তাদের লেখাপড়া শিখতে চাওয়াটাও ছিল ঘোর অপরাধের ৷ এমনকী মনে মনে ইচ্ছে করাটাও ছিল কতটা ভয়ের, তা জানতে পারি রাসসুন্দরীর আত্মজীবনী পড়ে, মনে পড়ে যায় রামায়ণে শূদ্র শম্বুকের তপস্যা করার অপরাধে মাথা কাটা যাওয়ার কথা। কিন্তু কী তার কারণ'? মেয়েরা ‘অল্পবুদ্ধি’ বলে ? মেয়েদের বুদ্ধির পরীক্ষা কবেই বা নেওয়া হল যে বলা হচ্ছে তারা অল্পবুদ্ধি— প্রশ্ন করেছিলেন রামমোহন । নাকি আসল কারণ এই যে, অসির চেয়ে মসির দাপট কিছু কম নয়, আর সেই দাপটের ক্ষেত্র থাকবে পুরুষেরই করায়ত্ত, নারীর সেখানে প্রবেশাধিকার থাকবে না—সেইটেই পুরুষপ্রতাপী সমাজে স্বাভাবিক ? তবু এত বারণের মধ্যেও রাসসুন্দরীর মতো, কিংবা তারও অর্ধশতাব্দী পর করিমুন্নেষার মতো নাছোড় বাঙালিনিরা নিজেদের একান্ত চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেও ফেললেন। নব্যশিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকেরাও সকলে না হলেও কেউ কেউ চাইলেন সহধর্মিণীকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলতে । সনাতনী সমাজের শত বাধাদান সত্ত্বেও মেয়েদের জন্যে কিছু কিছু বিদ্যালয়ও চালু হল, কিছুটা মিশনারিদের প্রয়াসে, কিছুটা বা দেশীয় আলোকপ্রাপ্ত সম্ভ্রান্তজনের ইচ্ছায় । নানাভাবে শিক্ষায় সুযোগ পাবার ফলে মেয়েদের লেখা চিঠি সাময়িক পত্রে প্রকাশ পেতে পারল উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই, সংখ্যায় খুব অল্প হলেও। এতই অল্প যে, তাতে বলা যাবে না মুদ্রণ-সংস্কৃতিতে জায়গা পেয়ে গেলেন মেয়েরা ; একটু একটু করে তাঁরা সে জায়গা অধিকার করে নিতে পারলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।