পশ্চিমি বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে ক্যালকাটা এবং বেঙ্গলের পরিচয় অজানা ছিল না, তবু চমকটা সামান্য হয়নি। একে তো ব্রিটিশ ভারতের এক প্রাদেশিক ভাষার কবি, তার উপরে তাঁর শ'খানেক কবিতার নিজেরই করা সরল গদ্যানুবাদের এক ক্ষীণাঙ্গী সংকলন Gitanjali (Song Offerings)। সেই বই যে প্রকাশের পরে বছর না ঘুরতেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান পেল, এমন আশ্চর্য ঘটনা তো জগৎসংসারে রোজ রোজ ঘটে না । বিশ্বসভায় স্থান পাবার ঢের আগেই কবি ও তাঁর কাব্য যখন ইংরেজ ভাবুক সমাজকে আলোড়িত করে তুলেছে, তখন সেই কবির ভালোও লাগছিল, আবার নিজের নামের এই ঢেউ-তোলা অস্বস্তিতেও ফেলেছিল। আর যখন নোবেল প্রাইজ পেয়ে খ্যাতির স্রোতে ভেসে যাবার উপক্রম, মনে হচ্ছিল কুকুরের লেজে একটা টিন বেঁধে দিলে সেটা যেমন চলতে-ফিরতে যথেচ্ছ আওয়াজ করে বেচারাকে অস্থির দিশাহারা করে তোলে, তাঁরও সেই দশা হয়েছে। জীবনে এমন একটা অভাবিত ঘটনা যে ঘটে গেল, তার অব্যবহিত আগে পর্যন্ত তিনি একেবারেই বঙ্গভাষার এক কবি। বাংলা দেশের বাইরে তাঁর পরিচিতি প্রায় নেই বললেই চলে। 'বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা'— সত্য হয়ে উঠুক, তারই জন্য কাজ করেছেন, স্বজাতিকে তারই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। এ সত্ত্বেও বাঙালির কবি নন তিনি কোনোদিনই। প্রবীণ বয়সে বলেছিলেন: আমি পৃথিবীর কবি যেথা তার যত উঠে ধ্বনি আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি, পৃথিবীর কবি তিনি নবীন বয়সেও। মুক্ত আকাশে পক্ষবিস্তার করেছে তাঁর কবিসত্তা, দেশখণ্ডের সীমানায় বদ্ধ নয় সে, বিশ্বজোড়া ফাঁদ পাতা তার জন্য। উনবিংশ শতাব্দীর শেষপ্রহর তখন। জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাজে প্রায়ই তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয় পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নানা উপলক্ষে কলকাতায় আসাযাওয়াও করতে হয়, তবে কাজকর্মের আড়ালে অন্তর-উজ্জীবনের ও সাহিত্যচর্চার আসন তাঁর পাতা হয়েছে প্রধানত নাগরিক কোলাহল থেকে বহুদূরে বাংলার উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির নিভৃত সান্নিধ্যে। সেইখানে নিজের সঙ্গে তাঁর নিয়ত বোঝাপড়া। বৈরাগ্যসাধন তাঁর জন্য নয় অবশ্য, সমাজ-সংসারের অসংখ্য বন্ধনের মধ্যে মুক্তির সন্ধান করেন তিনি। দশের কাছে খ্যাতি সম্মান যেমন পান, সমালোচনা ব্যঙ্গ বিরুদ্ধতার স্রোতও অবিরত আঘাত হানে। তবে অনুরাগী বন্ধুরাও সংখ্যায় কম নন, তাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁদের ভালোলাগা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্যক্ষেত্রের বাইরেও তাঁদের নানা দাবি, নানা প্রত্যাশা। সে দাবি ও প্রত্যাশাকে যথাসাধ্য মর্যাদা দেন কবি। বঙ্গসমাজ ও বঙ্গসাহিত্যের জন্য প্রয়োজনবোধ করলে অমিত্ররাও তাঁর সামনে হাত পেতে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন না।
Title
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি এক জাগে, গীতাঞ্জলি Gitanjali: রূপে রূপান্তরে