"বিসর্জন" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার প্রথম স্তরে কারুণ্যস্নেহের আলােকে হৃদয়ারণ্য হইতে নিষ্ক্রমণ সূচিত। দ্বিতীয় স্তরে কর্তব্যের সঙ্গে প্রেমের, রূপের সঙ্গে রসের, সংসারের সঙ্গে সত্যের সংঘর্ষ প্রতিফলিত। রাজা-ও-রাণীতে এই বিরােধের অবসান ঘটিয়াছে আত্মবিসর্জনে। বিসর্জন (১৮৯১) নাটকে শুধু আত্মবিসর্জন আছে, কিন্তু শুধু তাহাতেই সমস্যার সমাধান মিলে নাই, আরাে উপরে কঠোরতর ত্যাগের মধ্য দিয়া বিরােধের অবসান মিলিয়াছে। বৌঠাকুরাণীরহাটে যেমন রাজা-ও-রাণীতে তেমনি প্রেমের শ্রান্তি সৌভ্রাত্র্যের ছায়ায় অপনােদিত। কিন্তু বিসর্জনে এবং রাজর্ষিতে শুষ্ক কর্তব্যের তৃষা বাৎসল্যের ধারাবর্ষণে মিটিয়াছে। বিসর্জনের সমস্যা, “কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ”। বিসর্জন রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা পরিচিত—ধরনের বিশিষ্ট নাটক। অভিনয়ের দিক দিয়াও বিসর্জনের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। নাট্যরচনায়ও রবীন্দ্রনাথ শেষ অবধি নূতন নূতন ধাঁচ ও ছাঁচ সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন, পুরাতনের পুনরাবৃত্তি তাহার কখনাে রুচিকর ছিল না। কবিতায় ও গানে যেমন রচনার রূপটি প্রথম হইতেই রবীন্দ্রনাথের মনে সুস্পষ্ট আকার লইত নাটকে সর্বদা তেমন নয়। এবং বিসর্জনে ইহার ব্যতিক্রম পাই। তাই অভিনয়ে প্রয়ােজন উপলক্ষে ইহাতে পুনঃপুনঃ পরিবর্তন ঘটিয়াছে। রাজর্ষি উপন্যাসের প্রথমাংশ লইয়া বিসর্জনের আখ্যানবস্তু পরিকল্পিত। রাজর্ষির নায়ক গােবিন্দমাণিক্য, বিসর্জনের নায়ক জয়সিংহ। তাই জয়সিংহের আত্মহত্যা নাট্যকাহিনীতে যবনিকাপাত করিয়াছে। প্রথম সংস্করণে রাজর্ষির সঙ্গে যােগ বেশি স্পষ্ট ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণ হইতে হাসির ও কেদারেশ্বরের ভূমিকা বাদ যাওয়ায় এই যােগ কতকটা অস্পষ্ট হইয়াছে। প্রথম সংস্করণের আরাে দুইটি ভূমিকা—অন্ধ বৃদ্ধ ও পরিচারিকা দ্বিতীয় সংস্করণে বাদ গিয়াছে। ধ্রুবর ও অপর্ণার ভূমিকাও ছােট হইয়াছে। বিসর্জনে নাট্যরস জমিয়াছে অন্ধ সংস্কার, মূঢ় কর্তব্যনিষ্ঠা ও ভ্রান্ত অধিকারবােধের সঙ্গে গভীর হৃদয়বৃত্তি, উদার জ্ঞান ও নিরাসক্ত জীবনবােধের সংঘর্ষে। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি অনুভব করিয়াছে নায়ক জয়সিংহ। অন্যথা একপক্ষে রঘুপতি ও গুণবতী, অপর পক্ষে গােবিন্দমাণিক্যের ও অপর্ণার। গােবিন্দমাণিক্যর ও অপর্ণার মনে সংশয় নাই, তাহারা গভীর অনুভবের মধ্য দিয়া সত্যের আলােক পাইয়াছে। রঘুপতির চরিত্রদৃঢ়তার প্রতিষ্ঠা তাহার নিষ্ঠায় । গুণময়ীর চিত্ত বারে বারে দোল খাইয়াছে প্রেম ও সংস্কারের মধ্যে। সে সন্তানবিহীন, স্বামীর উপর কর্তহানির আশঙ্কায় অভিমানিনী। তাহার এই অত্যন্ত স্বাভাবিক দৌর্বল্যের ছিদ্রপথেই কাহিনীটি নাটকীয় পরিণতির দিকে উৎসারিত হইয়াছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।