৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বের ১৯৭১-এ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডারদের কাছে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আত্মসর্মপন করে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর তিন লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা । কিন্তু দূর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। স্বধীনতা লাভ করে ঠিকই, বিদেশী শত্রুমুক্তও হয় দেশ কিন্তু মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে, দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেয়ে যায় সেই সব দেশীয় শত্রুরা। যাদের রাষ্ট্রদ্রোহিরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট জাতির পিতার মৃত্যুর কারণে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আবার রাষ্ট্রিয়ভাবে পূর্ণবাসিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আইন করে এদের রক্ষা করে রাজনীতি করার এবং রাজনৈতিক দল গঠনেরও অধিকার দেয়া হয় । যার ফলশ্রুতিতে সেই সব দালালদের অনেকেই দেশের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। তারপর যতই দিন যেতে থাকে ততই এসব ঘাতক-দালালেরা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে সমাজের উচ্চস্থানে। তারপর থেকে অনেক দালাল নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অপকর্মের কথা অস্বীকার করতেও শুরু করে। স্বাধীনতার চেয়ে অনেক কম বয়সের একজন তরুণ আমি। বুদ্ধি বিবেচনা হবার পর থেকে দেখেছি কতবার, কত রকমভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সে বিকৃত ইতিহাস চর্চা বিপুলভাবে প্রসার লাভ করেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের বীরদর্পে উচ্চারিত বক্তব্য, বিবৃতি দেখে-শুনে অবাক হয়েছি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি দেখে বিস্ময়ে ভেবেছি, এও শুনতে হচ্ছে আমাদের! আমরাই এদের ভোট দিয়ে পাঠাচ্ছি মহান সংসদে! আমরাই আবার নেতা মানছি এদের! প্রজন্মের পর প্রজন্ম সঠিক ইতিহাসকে ধারণ না করলে এভাবেই বদলে যায় ইতিহাস। বিকৃত হয় সত্য আর রাষ্ট্রদ্রোহিরা রাষ্ট্রপ্রেমী বণে যায় অবলীলায়। এই ভেতরগত তাড়নাই আমাকে উষ্কে দিয়েছে এমন একটি বই সংকলনে। আমি মুক্তিযুদ্ধের গবেষক নই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠকমাত্র। বইয়ে সংকলিত সব তথ্য উপাত্ত দু’হাত ভরে নিয়েছি ১৯৭১-এ প্রকাশিত সংবাদপত্র থেকে আর আমাদের অগ্রজদের পরিশ্রমী, গবেষণালব্ধ বই থেকে। তাই বইয়ের পাতায় পাতায় মুদ্রিত হলো ’৭১-এর দেশদ্রোহি ঘাতক দালালদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার ইতিহাস। এই বইয়ে মুদ্রিত শব্দমালা যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে এই প্রজন্মের সোচ্চার উচ্চারণ। বাকি সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব শ্রদ্ধেয় পাঠকের।