নান্দীমুখ সমাজ-সংস্কারক বিদ্যাসাগর সাহিত্য স্রষ্টা বিদ্যাসাগরকে যেমন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, তেমনিই শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ গদ্যশিল্পী অবনীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এ হল আসলে প্রতিভার বহুমুখীনতার এক অভিশপ্ত দিক। কথায় কথায় যদিও আমরা Ver- satile প্রতিভার কথা বলি কিন্তু বাস্তবে Versatality'র কদাচিৎ সন্ধান লভ্য। আক্ষরিক অর্থেই অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন Versatality'র বিরল নিদর্শন। চিত্রশিল্পী রূপে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি, ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত, কিন্তু এই পরিচয়ই শেষ নয়। শিশুসাহিত্যিক হিসাবে তাঁর বিরল স্থান আমাদের শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে। তাঁর নালক, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা তারই অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন। গল্পপাঠে আগ্রহী কোন্ বাঙালি পাঠক না তাঁর টডের রাজস্থান অবলম্বনে রচিত ‘রাজকাহিনী' পড়েছে। আসর শিল্প সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার পরিচয় বিধৃত রয়েছে ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী'তে। এ হেন অবনীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান গদ্যশিল্পী। যদি চিত্রশিল্পী রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ নাও ঘটত, তথাপি প্রথম সারির একজন গদ্যশিল্পী রূপে তিনি চিরকাল বরণীয় হয়ে থাকতেন। অবনীন্দ্রনাথ একখানি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন (booklet), পুস্তক নয়, ‘মেয়েলী ব্রত’ (১৩৫০)। এই ক্ষুদ্রাকৃতির পুস্তিকাটিতে আমরা অবনীন্দ্রনাথকে পাই একজন অসামান্য গবেষক রূপে। এতটুকু অতিরঞ্জিত না করে বলা যেতে পারে যে এখনও পর্যন্ত বাংলার ব্রত নিয়ে রচিত এটিই সর্বোৎকৃষ্ট বই। পরবর্তীতে ব্রত নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, রচিত হয়েছে ঢাউস আকারের গ্রন্থ, কিন্তু সবই প্রায় নির্ভর করেছে অবনীন্দ্রনাথের পুস্তিকাটির ওপর। এমন একখানি তথ্যাসুল প্রামাণ্য গ্রন্থ তাও সীমিত পরিসরে রচিত, কদাচিৎ মেলে।
Abanindranath Tagore ৭ আগস্ট, ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক।তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। সে দিক থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতৃব্য ছিলেন। পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮১ থেকে ৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ৮৯ সালেই সুহাসিনী দেবীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০ এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সদস্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরি ভারত ভ্রমণে এলে আর্ট গ্যলারি পরিদর্শনের সময় তাদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দ্বায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধী লাভ করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্য রূপে দ্বায়িত্ব পালন করেন। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তার কাছে অবন শিখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তার আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অণুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত। কবিগুরু ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র কর্মসুচী শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন, ছোটদের পড়বার মত বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।তিনি ১৯৫১ সালে ৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।