"দুর্দিনের যাত্রী" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রাবন্ধিক হিসেবে বিশেষত্ব এখানেই যে, সমকালীন ব্রিটিশ-অসহযােগ আন্দোলনের যুগে তিনি সমাজ-রাজনীতি সচেতন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বক্তব্য সাহস ও স্পষ্টতার সঙ্গে তাঁর প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন। আমরা জানি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই আগস্ট অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বের হয়। নজরুল ‘ধূমকেতু’ তে যে সকল সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলােরই কতিপয়ের সঙ্কলন করে "দুর্দিনের যাত্রী" গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। নজরুলের দুর্দিনের যাত্রী(১৯২৬) গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহ প্রচণ্ড দেশপ্রেমত। স্বদেশ তখন ছিলাে ব্রিটিশ-শাসিত। ভারতবর্ষের সে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার ও অসহযােগ আন্দোলনের সময়পর্বের দেশকে কবি বলেছেন অত্যাচারের জাহান্নাম। নবী হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর পরশে যেমনি “নমরুদের” জাহান্নাম ফুল হয়ে হেসে উঠেছিলাে; তেমনি দেশপ্রেমিক ‘অভিনব তরুণ তপস্বীর দল’ এসে তাদের কার্যধারা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে যাতে দেশকে জাহান্নাম মুক্ত করে সে উৎকাক্ষা কবি এই প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছেন। শনিকে কবি বলেছেন তরুণদের কপালের জয়টিকা, ধূমকেতুকে বলেছেন রথ, মরুভূমিকে বলেছেন মাতৃক্রোড় এবং মৃত্যুকে বলেছেন বধূ—লক্ষ্মীছাড়ার দলের এই সতীর্থদের এহেন বাসনার মধ্যে দেশপ্রেমের জন্যে তাদের উদগ্ৰ-আকাঙ্ক্ষাময় কর্মের কথাই আসলে কবি অভিব্যক্ত করেছেন।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।