নারী ও পুরুষ নিয়ে মানুষের সমাজ গঠিত। সভ্যতার বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন করা হয়েছে। নারীর ভূমিকাও ছিল বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নরূপ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারীকে দেখা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে। সাম্প্রতিক কালে নারী অধিকার ও নারীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিশ্ব সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকেই নারী আন্দোলনের বিষয়টিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যান্য দিকের মতোই এক্ষেত্রেও অগ্রগতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে পরিস্ফুট। এমতাবস্থায় ‘রসূলের স. যুগে নারী স্বাধীনতা’ বইটি থেকে সংশ্লিষ্ট পাঠক চলমান নারী আন্দোলনের বিষয়ে দিক-নির্দেশনা পাবে। এই বইটি প্রখ্যাত লেখক আবদুল হালীম আবু শুক্কাহর ‘তাহরীরুল মারআ ফী আসরির রিসালাহ’ গ্রন্থের অনুবাদ। নবী সা. এর যুগে সাধারণ মুসলিম মেয়েরা পর্দার বিধান অনুযায়ী কুরআনের নির্দেশ অনুসারে শরীরের অপরিহার্য অংশ খোলা রেখে প্রয়োজন মতো মসজিদে নামায পড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক ও বাইরের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। ফিতনা প্রতিরোধকল্পে মুসলিম নারীকে গৃহাভ্যন্তরে রাখার বিধানটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। এর ফলে আল্লাহর হালাল করা অনেক বিষয় তাদের জন্য হারাম হয়ে গেছে এবং সামাজিক কর্মে মুসলিম নারীর অশগ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। বইটিতে আছে- নবী সা. এর যুগে সাধারণ মুসলিম মেয়েরা পর্দার বিধান অনুযায়ী কুরআনের নির্দেশ অনুসারে শরীরের অপরিহার্য অংশ খোলা রেখে প্রয়োজন মতো মসজিদে নামায পড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক ও বাইরের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। ইসলামী পুনর্গঠন মানেই হচ্ছে আল্লাহর দেয়া পথ- নির্দেশনার সন্ধানে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা। তারপর এ পথ-নির্দেশনাকে সমসাময়িক বাস্তবতার ওপর প্রয়োগ করে আল্লাহর হুকুমের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া। রসূল (স)-এর যুগে নারী প্রসংগে ইসলাম কি ভূমিকা অবলম্বন করেছিল এবং তাদের ব্যাপারে তার দিক-নির্দেশনা কি ছিল, তা সঠিক ও নির্ভুল প্রমাণাদির ভিত্তিতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থটিতে মূলত রিসালাতের যুগে নারীর জন্য ফিকহের সামাজিক বিধানের মৌল শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এখানে নিকট অথবা দূরে থেকে তার বিশেষ ও সাধারণ জীবনের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত বিভিন্ন বিষয় একত্র করা হয়েছে।
মিসরের খ্যাতনামা পণ্ডিত, গবেষক ও লেখক আবদুল হালীম আবু শুককাহ। তিনি একজন মহান শিক্ষক ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উম্মাহর মধ্যে সত্যিকারের ইসলামী চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার প্রকৃত আবেগ ছিল। তিনি শেখা ও শিক্ষাদানে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল হালীম আবু শুককাহ মিসর, সিরিয়া, কাতার ও কুয়েতে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কিছু সময়ের জন্য জর্ডানে বসবাস করেন। তারপরে সিরিয়ায় গমন করেন। কাতারে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৫৬- ১৯৬৭ সময়কালে কাতারে ছিলেন। তারপর কুয়েতে চলে যান যেখানে তিনি আরও বারো বছর (১৯৬৭-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত) বসবাস করেন। এই সময়ে তিনি প্রায়শই গ্রীষ্মের ছুটিতে সম্মানিত আলেম ও মুহাদ্দিস শায়খ নাসির আল-দীন আল-আলবানীর অধীনে হাদিস অধ্যয়ন করার জন্য সিরিয়ায় যেতেন। তার বিশেষ মনোযোগ ছিল হাদীস অধ্যয়নের প্রতি এবং তিনি হাদিস শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সিরিয়ায় গেলেই বিশেষ করে নিজের বোনকে দেখে আসতেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মিসরে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাকবিতন্ডা ও তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে নারী অধিকার সংক্রান্ত ইসলামের শাশ্বত সত্য আদর্শকে সমুন্নত করার মহান গৌরবের অধিকারী এই জ্ঞানপিপাসু পন্ডিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। গ্রন্থগুলোতে উদ্ধৃতি চয়নে কুরআন, সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকেই সহায়তা নিয়েছেন। আলোচিত বিষয়বস্তুকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত দলীল প্রমাণাদি পেশ করেছেন। তিনি বাস্তব জীবনে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থান সম্পর্কীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে অতি নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সামাজিক জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি ও আদর্শ সমাজ গঠনে নারীর দায়-দায়িত্ব এবং ভূমিকাকেও অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য হাওয়ালা এবং বিশদ ব্যাখ্যার বিরাট সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার উপর নিয়মিত জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখেছেন। তাঁর এ সব রচনার সংকলনগুলিও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বহু মূল্যবান দিক নির্দেশনা দেবে। লেখক সত্যিকার অর্থেই একজন ধৈর্যশীল, বিদ্যানুরাগী, আল্লাহপ্রেমিক ও রসূল (স)-এর একনিষ্ট অনুসারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি বারবার চিন্তা-ভাবনা করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ পন্ডিতবর্গের সাথে সে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত গবেষণা ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সীমিত পরিসরে যারাই তাঁর বন্ধুত্ব ও সাহচর্যলাভে সমর্থ হয়েছেন, তারাই নিঃসন্দেহে তাঁর যোগ্যতা, গভীর পান্ডিত্য, গঠনমূলক সমালোচনা, সত্যের পথে ধৈর্য ও সাহসিকতা, সত্যবাদিতা ও হকের উপর অবিচলতার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়েছেন। তিনি একজন সত্যবাদী, উদারমনা, বন্ধুসুলভ, বিজ্ঞ সমালোচক ও মহৎচরিত্রের অধিকারী হিসাবে সকলের নিকট সুপরিচিত ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনেও একজন যোগ্য শিক্ষক, যোগ্যতা ও পারদর্শিতার দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব, দোহা ইন্টারমিডিয়েট স্কুলের পরিচালক হিসেবে যোগ্য অধ্যক্ষের ভূমিকায় সদা তৎপর এবং সার্বিক উপায়-উপাদানকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উত্তম পন্থায় শিক্ষাদানের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। লেখকের লেখাগুলোই তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, সূক্ষ্ম অনুভূতি ও দক্ষ বিশ্লেষণ ক্ষমতার পূর্ণ সাক্ষ্য বহন করেছে। তিনি জীবন ও জগতের বাস্তবতাকে বুঝেছিলেন ও তার পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সত্যিকার ঈমান নিষিক্ত হৃদয় নিয়ে সুগভীর গবেষণা ও সংস্কারবাদী চিন্তা সহকারে সকল প্রকার কোলাহল ও অন্ধ অনুসরণের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসলামের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন।