পুরুষ ও নারী দুটি পৃথক সত্তা এবং দুটি পৃথক অস্তিত্ব। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন দুজন’কে পরস্পরের পরিপূরক করে তৈরি করেছেন। এখানে কেবল একজনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যজনের গুরুত্বহীন তা নয়। বরং উভয়ের ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য উভয়কেই আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে সমানভাবে। যদি একজনের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যজনের অধীনস্থ হতো তাহলে তার জবাবদিহির পাল্লা কিছুটা হালকা হতো। নারী তার সামর্থ অনুযায়ী এবং পুরুষ তার সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে যাবে। একদিকে তাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে আবার অন্যদিকে তারা পরস্পরের পরিপূরক। এভাবে তাদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও পারস্পরিক বন্ধনের একটি সিলসিলা গড়ে উঠেছে। বিবাহ বন্ধন এ সিলসিলার একটি প্রধান ও মূল অংশ। কিন্তু কেবলমাত্র এরি মধ্যে তাদের দায় দায়িত্ব ও কর্তব্যপালন সীমাবদ্ধ থাকেনি। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক ও দায়িত্ব, যেগুলি অনেক ক্ষেত্রে এই বন্ধনের বাইরেও হতে পারে, তাদের পালন করতে হবে। যেমন জ্ঞান অন্বেষণ, ভালো কাজ, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান, আল্লাহর দীনের প্রতি আহান জানানো, আল্লাহর পথে জিহাদ, পেশাগত কাজ, রাজনৈতিক তৎপরতা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, নিষ্করুষ বিনোদন, ভালো সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই এসব কাজে অংশ নিতে হবে। এভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সমাজের সুষ্ঠ পরিগঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং এজন্য আল্লাহর সামনে তাদের জবাবদিহি করাও সহজ হবে। এজন্য একটি মুসলিম সমাজে মুসলমান নারী ও পুরুষরা কিভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে তারই আলোচনা ‘রসূলের স. যুগে নারী স্বাধীনতা’ গ্রন্থের এই ২য় খণ্ডে বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে। গভীর পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মুসলমানদের কোনো কোনো দল ও ইসলামের দাবীদারদের একটি অংশ নারী অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছেন এর ফলে অনেকেই ইসলামকে অনুসরণ করার পরিবর্তে ঘৃণাভরে দূরে সরে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে লেখক তাঁর গ্রন্থে প্রতিটি বিষয়ের উপরেই কোন বিশেষ ব্যক্তি বা চিন্তাধারার অনুসরণ না করে পরিকল্পিতভাবে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অসংখ্য দলীল-প্রমাণাদির সমাবেশ ঘটিয়েছেন, যাতে এসব দলীল-প্রমাণই বিষয়বস্তুর সঠিক দিক-নির্দেশনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। তাই তিনি পারতপক্ষে কোন লেখক বা আলেমের মতামত থেকে দলীল-প্রমাণ গ্রহণ না করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যদি কোথাও তা গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তাও নিতান্তই কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অথবা কোন বিষয়কে স্পষ্টভাবে বুঝাবার জন্য বা কোন বিষয়ের মতভেদের ক্ষেত্রেই তার উল্লেখ করেছেন মাত্র। অকাট্য প্রমাণাদির গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যাবলী গ্রহণ এবং নিরলস ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরিশ্রম ও অসাধারণ কোরবানীর বিনিময়েই এ গ্রন্থখানাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছেন।
মিসরের খ্যাতনামা পণ্ডিত, গবেষক ও লেখক আবদুল হালীম আবু শুককাহ। তিনি একজন মহান শিক্ষক ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উম্মাহর মধ্যে সত্যিকারের ইসলামী চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার প্রকৃত আবেগ ছিল। তিনি শেখা ও শিক্ষাদানে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল হালীম আবু শুককাহ মিসর, সিরিয়া, কাতার ও কুয়েতে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কিছু সময়ের জন্য জর্ডানে বসবাস করেন। তারপরে সিরিয়ায় গমন করেন। কাতারে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৫৬- ১৯৬৭ সময়কালে কাতারে ছিলেন। তারপর কুয়েতে চলে যান যেখানে তিনি আরও বারো বছর (১৯৬৭-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত) বসবাস করেন। এই সময়ে তিনি প্রায়শই গ্রীষ্মের ছুটিতে সম্মানিত আলেম ও মুহাদ্দিস শায়খ নাসির আল-দীন আল-আলবানীর অধীনে হাদিস অধ্যয়ন করার জন্য সিরিয়ায় যেতেন। তার বিশেষ মনোযোগ ছিল হাদীস অধ্যয়নের প্রতি এবং তিনি হাদিস শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সিরিয়ায় গেলেই বিশেষ করে নিজের বোনকে দেখে আসতেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মিসরে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাকবিতন্ডা ও তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে নারী অধিকার সংক্রান্ত ইসলামের শাশ্বত সত্য আদর্শকে সমুন্নত করার মহান গৌরবের অধিকারী এই জ্ঞানপিপাসু পন্ডিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। গ্রন্থগুলোতে উদ্ধৃতি চয়নে কুরআন, সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকেই সহায়তা নিয়েছেন। আলোচিত বিষয়বস্তুকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত দলীল প্রমাণাদি পেশ করেছেন। তিনি বাস্তব জীবনে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থান সম্পর্কীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে অতি নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সামাজিক জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি ও আদর্শ সমাজ গঠনে নারীর দায়-দায়িত্ব এবং ভূমিকাকেও অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য হাওয়ালা এবং বিশদ ব্যাখ্যার বিরাট সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার উপর নিয়মিত জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখেছেন। তাঁর এ সব রচনার সংকলনগুলিও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বহু মূল্যবান দিক নির্দেশনা দেবে। লেখক সত্যিকার অর্থেই একজন ধৈর্যশীল, বিদ্যানুরাগী, আল্লাহপ্রেমিক ও রসূল (স)-এর একনিষ্ট অনুসারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি বারবার চিন্তা-ভাবনা করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ পন্ডিতবর্গের সাথে সে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত গবেষণা ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সীমিত পরিসরে যারাই তাঁর বন্ধুত্ব ও সাহচর্যলাভে সমর্থ হয়েছেন, তারাই নিঃসন্দেহে তাঁর যোগ্যতা, গভীর পান্ডিত্য, গঠনমূলক সমালোচনা, সত্যের পথে ধৈর্য ও সাহসিকতা, সত্যবাদিতা ও হকের উপর অবিচলতার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়েছেন। তিনি একজন সত্যবাদী, উদারমনা, বন্ধুসুলভ, বিজ্ঞ সমালোচক ও মহৎচরিত্রের অধিকারী হিসাবে সকলের নিকট সুপরিচিত ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনেও একজন যোগ্য শিক্ষক, যোগ্যতা ও পারদর্শিতার দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব, দোহা ইন্টারমিডিয়েট স্কুলের পরিচালক হিসেবে যোগ্য অধ্যক্ষের ভূমিকায় সদা তৎপর এবং সার্বিক উপায়-উপাদানকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উত্তম পন্থায় শিক্ষাদানের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। লেখকের লেখাগুলোই তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, সূক্ষ্ম অনুভূতি ও দক্ষ বিশ্লেষণ ক্ষমতার পূর্ণ সাক্ষ্য বহন করেছে। তিনি জীবন ও জগতের বাস্তবতাকে বুঝেছিলেন ও তার পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সত্যিকার ঈমান নিষিক্ত হৃদয় নিয়ে সুগভীর গবেষণা ও সংস্কারবাদী চিন্তা সহকারে সকল প্রকার কোলাহল ও অন্ধ অনুসরণের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসলামের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন।