মিসরের খ্যাতনামা পণ্ডিত, গবেষক ও লেখক আবদুল হালীম আবু শুক্কাহর ২০ বছরের সাধনার ফসল প্রায় ৩ হাজার পৃষ্ঠার অসাধারণ গ্রন্থটি ছয় খণ্ডে সমাপ্ত হয়। মূল গ্রন্থটির প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। গ্রন্থটি মুসলিম বিশ্বে নারীদের মধ্যে ইসলামী শরীয়তের বিধানের আওতায় অবস্থান করে ইসলামী সমাজ গঠন ও বিশ্বে ইসলামকে বিজয়ী শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে নতুন প্রেরণা ও প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শিক্ষিত মুসলিম মেয়েদের যে অংশটি সমাজের বিভিন্ন কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে চান আবার ইসলামী শরীয়তের সীমানার মধ্যেও অবস্থান করতে চান তাদের জন্য গ্রন্থটি নতুন পথের দিশা দেয়। যারা শরীয়তের সীমানাকে অস্বাভাবিক, অসহনীয় মনে করে তা এড়িয়ে চলতে চাইতেন তারাও দেখেন শরীয়ত তাদের ওপর দুঃসহ বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করেনি। বরং আল কুরআন ও বুখারী-মুসলিমের সহী হাদীসের মাধ্যমে তার নবী সা. এর নিকট থেকে একটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতি-সম্মত পথের সন্ধান পান। রসূলের যুগে নারী স্বাধীনতা গ্রন্থটি ইনশাআল্লাহ আধুনিক মুসলিম সমাজ পুনরগঠনে মুসলিম নারীদের ভূমিকার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদান রাখবে। এমন এক সময় লেখক গ্রন্থটি রচনা করেন যখন পাশ্চাত্যবাদ মুসলিম সমাজে ফাটল সৃষ্টি করেছে। মুসলিম নারী সমাজের শিক্ষিত অংশটি পাশ্চাত্য জীবন ধারা ও সমাজ দর্শনের স্রোতে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আবদুল হালীম আবু শুক্কাহ ইসলামী বিধানের ক্ষেত্রে যে নতুন চিন্তার দুয়ার খুলে দিয়েছেন তা সামাজিক পুনরগঠনে অনেক সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। মূল্যবান গ্রন্থখানায় নারী অধিকার সংক্রান্ত অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে ইসলামের ভূমিকা এবং গৃহে, সমাজ ক্ষেত্রে ও সমগ্র জীবন অঙ্গনে নারীর অবস্থান এখানে যথাযথভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মুসলিম নারীর সমস্যা সংক্রান্ত এ বইটি মূলত লেখকের দীর্ঘদিনের সাধনার ফল। এ বইটি লিখতে গিয়ে লেখক নারী অধিকার সংক্রান্ত কুরআন ও হাদীসে এমন অনেক দলীল-প্রমাণ দেখতে পেয়েছেন আমাদের সমাজে মুসলমানরা যার ঠিক বিপরীত আমল করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ বিকৃত চিন্তাধারার উপর তারা কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এ অবস্থায় লেখক সমাজে প্রচলিত এসব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের সাথে কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত দলীল-প্রমাণাদির যতই তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন, ততই প্রচলিত ধ্যান-ধারণার অসারতা তাঁর সামনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থেকেছে। ততই ইসলামে নারীর মর্যাদা এবং পারিবারিক ও সমাজ জীবনে মুসলিম নারীর গৌরবময় ভূমিকা তাঁর চোখে ভেসে উঠেছে।
মিসরের খ্যাতনামা পণ্ডিত, গবেষক ও লেখক আবদুল হালীম আবু শুককাহ। তিনি একজন মহান শিক্ষক ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উম্মাহর মধ্যে সত্যিকারের ইসলামী চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার প্রকৃত আবেগ ছিল। তিনি শেখা ও শিক্ষাদানে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল হালীম আবু শুককাহ মিসর, সিরিয়া, কাতার ও কুয়েতে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কিছু সময়ের জন্য জর্ডানে বসবাস করেন। তারপরে সিরিয়ায় গমন করেন। কাতারে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৫৬- ১৯৬৭ সময়কালে কাতারে ছিলেন। তারপর কুয়েতে চলে যান যেখানে তিনি আরও বারো বছর (১৯৬৭-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত) বসবাস করেন। এই সময়ে তিনি প্রায়শই গ্রীষ্মের ছুটিতে সম্মানিত আলেম ও মুহাদ্দিস শায়খ নাসির আল-দীন আল-আলবানীর অধীনে হাদিস অধ্যয়ন করার জন্য সিরিয়ায় যেতেন। তার বিশেষ মনোযোগ ছিল হাদীস অধ্যয়নের প্রতি এবং তিনি হাদিস শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সিরিয়ায় গেলেই বিশেষ করে নিজের বোনকে দেখে আসতেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মিসরে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি ১৯৯৫ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাকবিতন্ডা ও তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে নারী অধিকার সংক্রান্ত ইসলামের শাশ্বত সত্য আদর্শকে সমুন্নত করার মহান গৌরবের অধিকারী এই জ্ঞানপিপাসু পন্ডিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। গ্রন্থগুলোতে উদ্ধৃতি চয়নে কুরআন, সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকেই সহায়তা নিয়েছেন। আলোচিত বিষয়বস্তুকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত দলীল প্রমাণাদি পেশ করেছেন। তিনি বাস্তব জীবনে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থান সম্পর্কীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে অতি নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সামাজিক জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি ও আদর্শ সমাজ গঠনে নারীর দায়-দায়িত্ব এবং ভূমিকাকেও অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য হাওয়ালা এবং বিশদ ব্যাখ্যার বিরাট সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার উপর নিয়মিত জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখেছেন। তাঁর এ সব রচনার সংকলনগুলিও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বহু মূল্যবান দিক নির্দেশনা দেবে। লেখক সত্যিকার অর্থেই একজন ধৈর্যশীল, বিদ্যানুরাগী, আল্লাহপ্রেমিক ও রসূল (স)-এর একনিষ্ট অনুসারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি বারবার চিন্তা-ভাবনা করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ পন্ডিতবর্গের সাথে সে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত গবেষণা ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সীমিত পরিসরে যারাই তাঁর বন্ধুত্ব ও সাহচর্যলাভে সমর্থ হয়েছেন, তারাই নিঃসন্দেহে তাঁর যোগ্যতা, গভীর পান্ডিত্য, গঠনমূলক সমালোচনা, সত্যের পথে ধৈর্য ও সাহসিকতা, সত্যবাদিতা ও হকের উপর অবিচলতার স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়েছেন। তিনি একজন সত্যবাদী, উদারমনা, বন্ধুসুলভ, বিজ্ঞ সমালোচক ও মহৎচরিত্রের অধিকারী হিসাবে সকলের নিকট সুপরিচিত ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনেও একজন যোগ্য শিক্ষক, যোগ্যতা ও পারদর্শিতার দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব, দোহা ইন্টারমিডিয়েট স্কুলের পরিচালক হিসেবে যোগ্য অধ্যক্ষের ভূমিকায় সদা তৎপর এবং সার্বিক উপায়-উপাদানকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উত্তম পন্থায় শিক্ষাদানের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। লেখকের লেখাগুলোই তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, সূক্ষ্ম অনুভূতি ও দক্ষ বিশ্লেষণ ক্ষমতার পূর্ণ সাক্ষ্য বহন করেছে। তিনি জীবন ও জগতের বাস্তবতাকে বুঝেছিলেন ও তার পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সত্যিকার ঈমান নিষিক্ত হৃদয় নিয়ে সুগভীর গবেষণা ও সংস্কারবাদী চিন্তা সহকারে সকল প্রকার কোলাহল ও অন্ধ অনুসরণের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসলামের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন।