"চারুকলা বিচিত্রা (চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষার সহায়ক টেক্সট বুক)" দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকাঃ অল্প সময়ের মধ্যে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়াছে। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, বাঙ্গালীর মনে অতীত ইতিহাস জানিবার আগ্রহ জন্মিয়াছে। সাত শত বৎসর পরে বাঙ্গালী হিন্দু পরাধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সুতরাং যে যুগের ইতিহাস এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা জানিবার আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইবে, এরূপ ভরসা করা যায়। এই জন্যই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করিয়া এই নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হইল। এই সংস্করণে গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত পরিশােধিত করা হইয়াছে। প্রথম সংস্করণ মুদ্রিত হইবার পর বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে যে সমুদয় নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাও ইহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান, রাত উপাধিধারী নতুন এক রাজবংশ, ভবদের ভট্টের বালবলভীভুজঙ্গ উপাধির অর্থ, বল্লালসেনের গ্রন্থালয় এবং তাঁহার রচিত নূতন একখানি গ্রন্থ, ময়নামতী পাহাড়ে আবিষ্কৃত ভাস্কর্যের নিদর্শন, নূতন বাঙ্গালী বৈদ্যক গ্রন্থাকার প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। ২৫ খানি নূতন ছবিও যােগ করা হইয়াছে। তিন বৎসর পূৰ্ব্বে যখন এই গ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন গ্রন্থারম্ভে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে আলােচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলাম, “পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বিভাগের উপর নির্ভর করিয়া কোনাে প্রদেশের সীমা ও সংজ্ঞা নির্ণয় করা যুক্তিযুক্ত নহে।” এই নীতির অনুসরণ করিয়া বঙ্গ-বিভাগ সত্ত্বেও এই ইতিহাসে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে কোনাে পরিবর্তন করি নাই। যেখানে কোনাে জিলা বা বিভাগের উল্লেখ আছে, সেখানেও অবিভক্ত বঙ্গে ইহা যেরূপ ছিল তাহাই বুঝিতে হইবে। কিরূপে সুদূর প্রাচীনকাল, হইতে নানাবিধ বিবর্তন ও পরিবর্তনের ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা এক জাতিতে পরিণত হইয়াছিল, গ্রন্থশেষে তাহার আলােচনা করিয়াছি। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এই অংশের কোনাে পরিবর্তন করি নাই। কারণ অতীতকালের বাঙ্গালী যে এক জাতি ছিল, ইহা। ঐতিহাসিক সত্য। ভবিষ্যতের গর্ভে কী নিহিত আছে, তাহা কেহই বলিতে পারে । যদি বর্তমান বিভাগ চিরস্থায়ী হইয়া দুই বাংলার অধিবাসীর মধ্যে আচার, কৃষ্টি ও ভাষাগত গুরুতর প্রভেদেরও সৃষ্টি হয়, তথাপি বাঙ্গালীর এক জাতীয়তার ঐতিহ্য চিরদিনই বাঙ্গালীর স্মৃতির ভাণ্ডারে সমুজ্জ্বল থাকিবে। হয়তাে অতীতেও এই স্মৃতি ভবিষ্যতের পথ-নির্ণয়ে সহায়তা করিবে। এই হিসাবে গ্রন্থের এই অংশ পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর প্রয়ােজনীয় বলিয়াই মনে করি। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই গ্রন্থের এই অংশ রচিত হইয়াছিল। সুতরাং আশা করি কেহ ইহাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার আন্দোলন বা প্রচারকাৰ্য্য বলিয়া মনে করিবেন না। ভট্টপল্লী-নিবাসী শ্ৰীযুক্ত ভবতােষ ভট্টাচার্য মহাশয় বল্লালসেন-রচিত ব্রতসাগর গ্রন্থের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন। এই জন্য আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি। ' গ্রন্থােক্ত অনেক মন্দির, মূর্তি ও চিত্রের প্রতিকৃতি দেওয়া সম্ভবপর হয় নাই। ইহাতে এই সমুদয়ের বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টসাধ্য হইবে। যে সকল পাঠক এই সমুদয় প্রতিকৃতি. দেখিতে চান, তাঁহারা ঢাকা, রাজসাহী ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চিত্রশালার এবং কলিকাতা ও আশুতােষ যাদুঘরের মুদ্রিত মূর্তি-তালিকা, স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত “Eastern Indian School of Mediaevel Sculpture, কাশীনাত দীক্ষিতের “Excavations at Pahaarpur', ষ্টেলা ক্র্যামরিস প্রণীত “Pala and Sena Sculptures of Bengal”. শ্রীসরসীকুমার সরস্বতী রচিত “Early Sculpture of Bengal” এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত History of Bengal, Vol. I” প্রভৃতি গ্রন্থে প্রায় সমুদয় শিল্প-নিদর্শনের প্রতিকৃতিই পাইবেন। এই গ্রন্থােক্ত বর্ণনার সাহায্যে ঐ সমুদয় গ্রন্থের চিত্রগুলি আলােচনা করিলে, ইংরেজী-অনভিজ্ঞ পাঠকও বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও কৃষ্টির সৰ্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাহার অতীত শিল্পকলা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করিতে পারিবেন। সাধারণত যে সমুদয় চিত্র সুপরিচিত নহে-যেমন গােবিন্দভিটা ও ময়নামতীর পােড়া-ইট, চট্টগ্রামের বুদ্ধমূর্তি প্রভৃতি-তাহাই অধিকসংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিয়াছি। এই জন্য অনেক অধিকতর সুন্দর কিন্তু সুপরিচিত মূর্তি বাদ গিয়াছে। ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৮, ২৬, ১৫ (খ), ৩০ ও ৩১ সংখ্যক চিত্রের ব্লক ও ৪, ১০, ১৪, ১৬, ২৪, ২৫ সংখ্যক চিত্রের ফটো দিয়াছেন। আশুতােষ যাদুঘর কাশীপুরের সূৰ্য্যমূর্তি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কোটালিপাড়ার সূৰ্য্যমূৰ্ত্তির ব্লক দিয়াছেন। ইহাদের সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি।