রোমান্টিক কবি হিসেবেই রবীন্দ্রনাথ সমধিক পরিচিত। কিন্তু তিনি বাংলা সাহিত্য ধারার প্রায় প্রতিটি শাখায় দাপটের সাথে বিচরণ করেছেন এবং পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যও তাঁর লেখনীর স্পর্শে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর রচিত উপন্যাসের চতুর্থতম সদস্য 'চোখের বালি'। এ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম শক্তিমান সৃষ্টি। এই উপন্যাসেই তিনি প্রথম উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমসাময়িক সমাজের পাত্র-পাত্রীকে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করলেন। এই উপন্যাসে তিনি প্রথম কাহিনীর ভার পরিহার করে ব্যক্তিত্বের ফলস্বরূপ নানা সংকটকে উপন্যাসের বিষয় হিসেবে ব্য্যবহার করলেন। এই উপন্যাসেই তাঁর শক্তি এবং শক্তির সীমা দুয়েরই আভাস পাওয়া গেল। অথচ এর জন্য রবীন্দ্রনাথকে আগাগোড়া নতুন হতে হয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের দুঃসাহসিকতম লেখাও নয় 'চোখের বালি'। সেদিক থেকে বরঞ্চ 'নষ্টনীড়' অনেক সাহসিক পদক্ষেপ। তথাপি 'চোখের বালি'তেই জানা গেলো তিনি পূর্বের উপন্যাসের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবেন না। বুঝা গেল তখন পর্যন্ত প্রচলিত বাংলা উপন্যাসের ধারাকে ভেঙে নতুন পথে চলবেন তিনি। 'চোখের বালি' উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে প্রধান চরিত্র বিনোদিনীকে মাঝে রেখে। বিনোদিনী বিধবা। সে অনিন্দ্য সুন্দরী ও মনকাড়া ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। ছোট বেলায় একজন ইংরেজ নারীর কাছ থেকে তার শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছিল। সুতরাং সে লাভ করেছিল স্বাধীন ও সংস্কারমুক্ত জীবন চেতনা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।