১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের একটি আলো ঝলমল দিনে, ল্যুভে মিউজিয়মের ‘সালো কারি’ কক্ষে এক ভদ্রলোক ডিভানে হেলান দিয়ে আরামে বসে ছিল। এই বৃত্তাকার প্রশস্ত গাদি আঁটা আসনখানি অবশ্য পরবর্তীকালে ওই ঘরের মাঝখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার ফলে যেসব কলারসিকের পায়ের জোর কম তারা যৎপরোনাস্তি অসুবিধেয় পড়েছেন—তাদের আর আফসোসের শেষ নেই। তা সে যা-ই হোক, তিনি তো ডিভানের সবচেয়ে নরম জায়গাটি দখল করে আছেন। মাথাটি পিছনে হেলিয়ে, পা দু'খানি সামনে ছড়িয়ে দিয়ে সে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে মুরিল্লোর আঁকা ‘ম্যাডোনা’ দেখছে। চন্দ্রদূত বাহিত ম্যাডোনার সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে ভদ্রলোক যেন আপন ভঙ্গিমাটুকুও গভীরভাবে সম্ভোগ করছেন। মাথা থেকে সে টুপি খুলে ফেলেছে, লাল মলাটের ছোট্ট একখানি পরিচায়িকা বই তার পাশে খোলা রয়েছে, আর দুরবিন। বেশ গরম পড়েছে। তার উপর পথ চলে বোধহয় লোকটির গরম লেগেছে—সে বার বার কপালের উপর রুমাল বুলোচ্ছে। যেন ঘামের সঙ্গে ক্লান্তিও মুছে ফেলবার জন্যই সে মুখে রুমাল ঘষছে। অবশ্য এই মানুষটিকে দেখে টের পাওয়া যায় যে অল্পে শ্রান্ত হবার বান্দা সে নয়। তার লম্বা ছিপছিপে পেশল দেহাবয়ব থেকে আন্দাজ করা চলে যে তার একটা সহজাত প্রতিরোধপ্রবণতা রয়েছে। সে যেন নিজের অজ্ঞাতেই ক্লান্তিকে অক্লেশে উপেক্ষা করে। অবশ্য আজ তার যে মেহনত হয়েছে, বস্তুত এই ধরনের পরিশ্রমে সে অনভ্যস্ত—ল্যুভের ভেতরে শান্ত-মন্থর পায়চারিটা এমন কিছু কায়িক শ্রম নয়, হামেশাই সে ঢের ঢের কঠিন দৈহিক কসরত কাবিল করে আজকের চেয়ে অনেক কম কাবু হয়। আসলে এই বিশেষ অবসন্নতার বিশেষ দিনের হেতু হচ্ছে অনভ্যাস । ঝকঝকে ছাপা ওই দুর্ধর্ষ পরিচয় পুস্তিকার মধ্যে যতগুলো ছবির পাশে তারকা চিহ্ন আঁকা রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটি সে খুঁটিয়ে দেখা শেষ করেছে। এই মনোনিবেশে তার রীতিমতো কষ্ট হয়েছে আর চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। সৌন্দর্যবোধের আধিক্যে তার মাথা ধরে গেছে, তাই সে বসে পড়েছে। এছাড়া বাকি সব ছবিই সে দেখেছে, উপরন্তু সেই সব ছবির নকলের উপরও তার দৃষ্টি পড়েছে। আসল ছবিগুলোর চারধারে অজস্র অল্প বয়সী তরুণী মন দিয়ে নকলের কাজ করছে— উঁচু টুলের উপর দাঁড়িয়ে, লম্বা অঙ্গাবরণে পোশাক ঢেকে বিখ্যাত ছবির নকলনবিশি ফরাসি মেয়েদের এটা রেওয়াজ। এবং সত্যি কথা বলতে গেলে স্বীকার করতে হবে যে লোকটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসল ছবির চেয়ে তার নকলগুলোই যেন বেশি তারিফ করছে।
(১৮৪০-১৯১৬) একটি সরস লেখা রচনা করতে গেলে যেমন রচয়িতার চাই অভিজ্ঞতা, বাস্তববোধ আর অপূর্ব বস্তু নির্মাণের প্রতিভা, তেমনি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে সাহিত্যিকের মধ্যে চাই অনুরূপ গুণের সমাবেশ। হেনরি জেমসের চরিত্রে উপরোক্ত গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল, আর তাই তিনি লাভ করেছিলেন কালজয়ী সাহিত্যিকের সম্মান। আমেরিকার উপন্যাস জগতে তিনি একদিন যে ভাবনার ঢেউ তুলেছিলেন, তার তরঙ্গ প্লাবিত করেছিল সারা বিশ্ব । তার গভীর মনস্ততত্ত্বমূলক উপন্যাসগুলো আজও সৎ পাঠকের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বিশটির বেশি প্রথম শ্রেণির উপন্যাস, এক শতেরও বেশি কাহিনি তিনি তার আগ্রহী পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। হেনরি জেমস উপন্যাস সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত মতবাদ পোষণ করতেন : “বিভিন্ন চরিত্র তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে নিজস্ব বিশেষত্বের বিকাশ ঘটাবে আর সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠবে একটি বলিষ্ঠ কাহিনি।” ভ্রমণ যে সাহিত্যিকের চিত্তকে পুষ্ট করে তা তিনি জানতেন। তাই বহুদিন তাকে ভ্রাম্যমাণ জীবন-যাপন করতে হয়েছে। এই সময়কার অভিজ্ঞতার মণি-মানিক্যগুলো সযত্নে তিনি তুলে রেখেছেন তার সৃষ্টির ভাণ্ডারে । বাল্যকালে বড় বেশি অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন হেনরি জেমস। একান্ত রাজুক স্বাভাবের এই বালকটি পরবর্তী জীবনে যে বিস্ময়কর কথাকার রূপে বিশ্ববাসীর প্রীতি ও শ্রদ্ধা এমনভাবে আকর্ষণ করতে পারবেন, তা কে জানত।