ফরাসী দেশের ছোট্ট একটি শহর—লা-ব্রিয়ে। সেইখানে বাস করে এক গরিব কাঠুরে—তার নাম জাঁ ভালজাঁ। লম্বা খুব বেশি নয়, কিন্তু ঘাড় আর বুক তার অসম্ভব চওড়া। দেহের পেশী এক একটা যেন লোহার ডাণ্ডা। দৈত্যের মতো শক্তি ভ্যালজাঁর দেহে। শক্তির তার দরকারও আছে। উদয়াস্ত কাঠ চেরাই তার ব্যবসা। তারই উপার্জনে অতবড় সংসারটা তাকে প্রতিপালন করতে হয়। বিধবা দিদির সাত সাতটি ছেলেমেয়েকে পুষতে হয় ভ্যালজাঁকে। দিদি তো আছেনই। এই দিদির হাতেই ভ্যালজাঁ একদিন মানুষ হয়েছিল, কারণ শৈশবে জ্ঞান হয়ে অবধি বাবা-মাকে সে দেখেনি কোনোদিন। সাতটি শিশু—সবচেয়ে বড়টির বয়স বছর বারো। সবচেয়ে ছোটটির এখনো কথা ফোটেনি। ভগিনীপতিটা টপ্ করে মরে গেল, দারুণ শীতে বুকে ঠাণ্ডা বসে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স তখন ভ্যালজাঁর। দায়-ঝক্কি তার মাথায় কিছু ছিল না তখনও। হঠাৎ ষোল আনা ঝক্কি এসে চেপে ধরল যখন, সে কিন্তু মুষড়ে পড়ল না। কুড়োলখানা কাঁধে নিয়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। ওই কুড়োলই সাতটা বাচ্চাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেই থেকে। ভ্যালজাঁর কাজের অভাব হয় না। তার শক্তিও যেমন, নিষ্ঠাও তেমনি। যত শক্ত কাঠই হোক, ভ্যালজাঁ চিরতে ভয় পায় না। যতক্ষণই একটানা খাটতে হোক, কাজে ফাঁকিও দেয় না। তাই শহরের লোক খোঁজে তাকে। ডেকে এনে কাজ দেয়। কিন্তু চিরদিন সমান যায় না। এবার ভ্যালজাঁরও কাজের অভাব হয়েছে।
ভিক্টর মারি হুগো ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০২ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহন করেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিশাল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার সন্তান ছিলেন তিনি। একাধারে সাহিত্য এবং রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ফ্রান্সে সা¤্রাজ্য আইন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া এবং সেই প্রক্রিয়ার নানান উত্থান-পতনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্যারিসে বসবাসরত ভিক্টর হুগো তরুণ বয়সেই তার কবিতা, কল্পকাহিনি এবং নাটকের জন্য বিখ্যাত এবং কখনো কুখ্যাতও হয়েছিলেন। ১৮৪৫ সালে, তার বিখ্যাত গ্রন্থ লা মিজারেবল লেখার সময়, রাজা তাকে ফ্রান্সের উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আইনসভার সর্বোচ্চ দলের সঙ্গে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। তিনি সেখানে সবার জন্য বিনা খরচে লেখাপড়া, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির ব্যাপারে কাজ করা শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে যখন রাজ্যে উন্নতির জোয়ার স্পষ্টভাবে কড়া নাড়ছিল, তিনি লা মিজারেবল লেখা বন্ধ করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ১৮৫১ সালে যখন দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন, হুগোর রাজনৈতিক চেতনার বিরোধিরা তাকে বৃটিশ চ্যানেলের একটি দ্বীপে নির্বাসনে বাধ্য করে। নির্বাসনে থেকেই ১৮৬০ সালে তিনি আবার লা মিজারেবল লেখার কাজে হাত দেন এবং পরের বছর উপন্যাসটি শেষ করেন। ১৮৭০ সালে সম্রাটের পতন হলে হুগো ফ্রান্সে ফেরত আসেন, যেখানে তাকে গণতন্ত্রের মানসপূত্র হিসেবে বিপুলভাবে সম্মানিত করা হয়। ২২ মে ১৮৮৫ সালে ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর পরে ফ্রান্সের রাস্তায় তার কফিন বয়ে নেবার সময়ে বিশ লাখ মানুষের ঢল নামে। সেদিন ফ্রান্সের জনগণ যতভাবে সম্মান জানানো সম্ভব, জানিয়ে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।