বিংশ শতাব্দীর প্রথম পঁয়ত্রিশ বছরে আমেরিকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো দুই লাখের বেশি বই প্রকাশ করেছে। সেগুলোর বেশিরভাগই অপাঠ্য এবং অনেকগুলো খরচের অর্থ তুলতেই ব্যর্থ হয়েছে। অনেক, আমি কি ভুল বললাম? না। আমেরিকার বিখ্যাত একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্টই আমার কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি গত ৭৫ বছর ধরে প্রকাশনা জগতে আছেন। ফলে এটা বলা যায়, তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কিন্তু এখনো তিনি প্রতি আটটি বইয়ের মধ্যে সাতটিতেই আর্থিক দিক দিয়ে লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে কেন তারপরও আমার মতো একজন ব্যক্তি আরেকটি বই লেখার সাহস পাচ্ছে? আর আমি বইটি লিখলে আপনিই-বা কেন সেটি পড়তে যাবেন? দুটি প্রশ্নই কিন্তু সুন্দর এবং যুক্তিসঙ্গত। আমি দুটোরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। আমি ১৯১২ সাল থেকে নিউইয়র্কে ব্যবসায় এবং পেশাগত নারী-পুরুষদের জন্য একটি শিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে আসছি। প্রথমে আমি কেবল জনসমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার কোর্স পরিচালনা করেছিলাম। কোর্স এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে প্রাপ্তবয়স্করা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। তাদের মতামত মন খুলে প্রকাশ করতে পারে। আর এটা যেন তাদের ব্যবসায় কিংবা জনতার সামনে বক্তৃতায়ও দারুন ফল বয়ে আনতে পারে। কিন্তু সময় যত গড়াতে লাগল ততোই আমার এই উপলব্ধি আসতে শুরু করল যে, এই প্রাপ্তবয়স্কদের সবচেয়ে বেশি দরকার কথা বলার যোগ্যতা তথা এর কলাকৌশল শেখা। এই শিক্ষাই তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে, সামাজিক যোগাযোগে তথা জনসংযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমি এটাও অনুভব করলাম আমার নিজেরও এই ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার। আমি যখন অতীত দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়েছিলাম তখন আমার মধ্যেও একটা শূন্যতার আবেগ ধরা দিয়েছিল। আমার মধ্যে একটা আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিল যে, বিশ বছর আগে এমন একটা বই যদি থাকত তাহলে আমার জীবনটা আজ কতই সুন্দর এবং স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হতে পারত।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।