“আমার লাদাখ যাত্রা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ আমার লাদাখ যাত্রা’ রাহুল সাংকত্যায়নের সেরা একটি ভ্রমণ কাহিনি । বইটির শিরােনাম ‘আমার লাদাখ যাত্রা হলেও রাহুল তার। এই বইতে শুধু লাদাখ ভ্রমণের বিবরণই দেননি। একই সঙ্গে তিনি শ্রীনগর, জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণের বিবরণও দিয়েছেন। বিবরণ দিয়েছেন। তার যাত্রাপথের অন্যান্য স্থানেরও। এবং তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শুধু ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার ‘তিব্বতে সওয়া বছর’সহ অন্যান্য গ্রন্থের মতাে এই গ্রন্থেও তিনি শ্রীনগর, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের ইতিহাস-ভূগােলের চমৎকার একটি চিত্র এঁকেছেন। এখানে বলা দরকার যে, রহুল একবার নয়, একাধিক বার কাশ্মীর লাদাখ ভ্রমণ করেছেন। এবং তা একেবারে নিছক ভ্রমণের জন্য ভ্রমণ নয়, তিনি ভ্রমণ করেছেন প্রাচীণ বৌদ্ধ সাহিত্য, দর্শন ও বিচারশাস্ত্র সম্বন্ধীয় গ্রন্থের অনুসন্ধানে। এবং এ কাজে তিনি সফলও হন। শেষ দফার লাদাখ ভ্রমণে তিনি সংগ্রহ করে আনেন দু'মনেও বেশি প্রাচীন পুঁথিপত্র । যেমনটি তিনি পরবর্তী সময়ে করেছিলেন তিব্বত ভ্রমণের সময়। এক্ষেত্রে আর একটি কথা বলা দরকার যে, হিমালয় তাঁকে বার বার আকর্ষণ করেছে বিশেষভাবে । তিনি প্রথমবার হিমালয়ে এক সংক্ষিপ্ত সফর করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে। এরপর দুর্গম, কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম করে বদ্রী, কেদার, যমুনানেত্রী, গঙ্গোত্রী ভ্রমণ করেন। তারপর হিমালয় পাড়ি দিয়ে তিব্বত, ভুটান সফর করেন। একবার নয়, একাধিক বার । পাহাড়, পর্বত, গিরিশৃঙ্গ আর বরফের রাজ্য অতিক্রম করা যে কি কষ্টসাধ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকের যুগে হিমালয়ে যাবার কিছু কিছু পথ ঘাট হয়েছে, কিন্তু সেই যুগে রাহুলের যুগে এর কিছুই ছিলাে না। পাহাড়-পর্বতের পুরাে পথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে পায়ে হেঁটে অবশ্য মাঝেমধ্যে ঘােড়া, গাধা ও খচরের পিঠে চেপেও। ভাবতেও গা শিউরিয়ে উঠে। সমতল ভূমির রাহুল ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা পরিব্রাজক। তাই পাহাড়, পর্বত, নদ-নদী কোনাে বাঁধাই তার অন্য বাধা হতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে আরাে একটি বিষয় উল্লেখযােগ্য যে, প্রথা সিদ্ধ-জীবন যাত্রার বিপরীত মুখী ব্যক্তিছিলেন রাহুল । মাত্র ন’বছর বয়সে তার ঘর ছাড়াই এর বড় প্রমাণ । এমনকি তিনি তার অদম্য ইচ্ছাপূরণের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে পদব্রোজে অযােধ্যা ও মােরাদাবাদ এবং বিনা টিকেটে হরিদ্বার ভ্রমণ করেন । এখানে একটা বিষয় খুব লক্ষণীয় যে, রাহুল চরিত্রের দিক দিয়ে ভবঘুরে হলেও জ্ঞান অন্বেষণে ভীষণ মনােযােগী ছিলেন। তাই তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার ভাষা শিখেছেন। শুধু শেখেনইনি তিনি ঐসব ভাষায় পুস্তক রচনা করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তার অসাধারণ প্রতিভা আর নিরলস জ্ঞান সাধনার জন্যে। এই জ্ঞান সাধকের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল কেদার নাথ পাণ্ডে। কিন্তু তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রাম উদর দাস করেন। এই নাম পরিবর্তন করে তিনি পারাসা’ মঠে প্রথা সিদ্ধ সাধুতে পরিণত হন। এই ঘটনার আরাে পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়ন নাম ধারণ করেন। অবশ্য পরে রাহুল মার্কসবাদের সংস্পর্শে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করেন।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।