‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং (মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি)’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক দুটি মহান আবিস্কার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স। প্রথমটির কাজ মহাকর্ষ, স্থানকাল তথা মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসর নিয়ে। দ্বিতীয়টি কাজ করে অতিক্ষুদ্র পরমাণুর গহন রাজ্য। নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরীক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবহারিক দিকে দুটি তত্বেই সফল। তবে দুটি তত্ব একই সাথে সফল হতে পারে না, অন্তত তাদের বর্তমান রূপে। কিন্তু এ দটিকে একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ব পেতে পদার্থবিদদের একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। স্ট্রিং থিওরিকে একসময় এমনই এক পূর্ণাঙ্গ তত্ব বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এ তত্ব থেকে পাওয়া কোনো ভবিষ্যদ্বাণী এখনো বাস্তব পরিক্ষায় প্রমান করা যায়নি। ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবণা ক্ষীণ বলেই বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। তাই এখন নতুন এক তত্বের খোঁজে মাঠে নেমেছেন তারা, যা দিয়ে বিপুল পরিসরের মহাবিশ্ব ও ক্ষুদ্র পরিসরের পরমাণু রাজ্যকে একসুতোয় গাথাঁ যাবে। এ তত্বেরই পোশাকি নাম থিওরি অব এভরিথিং। কিন্তু কেমন হবে বহু প্রত্যাশিত সেই তত্ব? কী করা যাবে সেই তত্ব দিয়ে? তাতে কী এই মহাবিশ্বের সব রহস্যের জবাব পাওয়া যাবে। এ বইতে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তাত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। আকারে ক্ষীণ, বক্তব্যে সংক্ষিপ্ত হলেও যা গুরুত্ব ও তাৎপর্য্ বিপুল।
সূচীপত্র: * মুখবন্ধ-ড. আরশাদ মোমেন ৯ * অনুবাদকের কথা ১১ * লেখকের ভূমিকা- স্টিফেন হকিং ১৭ * প্রথম বক্তৃতা মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা ১৯ * দ্বিতীয় বক্তৃতা প্রসারণশীল মহাবিশ্ব ৩২ * তৃতীয় বক্তৃতা কৃষ্ণগহ্বর ৫০ * চতুর্থ্ বক্তৃতা কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয় ৭৮ * পঞ্চম বক্তৃতা মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি ৯৬ * ষষ্ঠ বক্তৃতা সময়ের দিক ১১৭ * সপ্তম বক্তৃতা সার্বিক তত্ব ১২৭ * একজন স্টিফেন হকং ১৪২ * পরিভাষা ১৪৬
লেখকের ভূমিকা এই ধারাবাহিক বক্তৃতাগুলোকে আমি মহাবিস্ফোরণ থেকে কৃষ্ণগহ্বর পর্যন্ত মহাবিশ্বের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভাবনার একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রথম বক্তৃতায় মহাবিশ্ব সম্পর্কে অতীতের ধারণাগুলো সংক্ষেপে বলব। একই সঙ্গে মহাবিশ্বের বর্তমান চেহারা কিভাবে পেলাম, সেটিও থাকবে এখানে। দ্বিতীয় বক্তৃতায় মহাকর্ষ্ সম্পর্কে নিউটন আর আইনস্টাইন তত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মহাবিশ্ব স্থির হতে পারে না, মহাবিশ্বকে হয় প্রসারণশীল, নয়তো সংকোচনশীল হতে হবে-তাঁদের তত্বগুলো কীভাবে এই সিদ্ধান্তের দিকেই ইঙ্গিত করে, এখানে সেটিই দেখাব। এতে দেখা যায়, আজ থেকে ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন বছর আগের মধ্যবর্তী কোনো একটি সময়ে এই মহাবিশ্বের ঘনত্ব অবশ্যই অসীম ছিল। একেই বলে মহাবিস্ফোরণ। সম্ভবত মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই। তৃতীয় বক্তৃতায় আমি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আলোচনা করব। বিপুল আয়তনের নক্ষত্র কিংবা বিশাল কোনো বস্তু তার নিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে সংকুচিত হতে থাকলে একসময় তা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারন তত্ব অনুযায়ী, কেউ যদি কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপ দেওয়ার মতো বোকামি করে, তাহলে সে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। সে আর কোনো দিন কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। বরং সবশেষে যতটা সম্ভব এদের ইতিহাস একটা যন্ত্রণাদায়ক সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুতে পৌছাবে। তবে সাধারণ আপেক্ষিতা হচ্ছে চিরায়ত তত্ব। তাই এই তত্ব কোয়ন্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চতার নীতিকে গোনায় ধরে না। কৃষ্ণগহ্বর থেকে শক্তি বেরিয়ে আসার ঘটনাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কীভাবে সমর্থ্ন করে, সেটিই চতুর্থ্ বক্তৃতায় আমি ব্যাখ্যা করব। কৃষ্ণগহ্বরকে যতটা কালো হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তা আসলে তত কালো নয়। পঞ্চম বক্তৃতায় মহাবিস্ফোরণ এবং মহাবিশ্বের উৎপত্তিতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধারণা ব্যবহার করব। এই তত্ব ইঙ্গিত করে যে স্থানকাল সসীম হতে পারে, তবে এর কোনো সীমানা বা কিনারা থাকবে না। এটা অনেকটা ভূপৃষ্ঠের মতো, তবে এর মাত্রা দুইয়ের চেয়ে বেশী। পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো সময়-প্রতিসাম্য হওয়া সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ থেকে অতীত অনেক আলাদা। নতুন এই সীমানা প্রস্তাব এই বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, তা দেখাব ষষ্ঠ বক্তৃতায়। সবশেষে সপ্তম বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করব কীভাবে আমরা একটি একীভূত তত্ব খুঁজে পেতে পারি। এই তত্বটিতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, মহাকর্ষ্ ও পদার্থবিদ্যার অন্যান্য মিথস্ক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে।যদি কখনো সেটি অর্জ্ন করা যায়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমরা এই মহাবিশ্বকে এবং এতে আমাদের সঠিক অবস্থান বুঝতে পারব। স্টিফেন হকিং
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং একাধারে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাবিশ্ববিজ্ঞানী এবং লেখক। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক মহাকাশবিদ্যা বিভাগের পরিচালক এবং অধ্যাপক ছিলেন। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা এই মেধাবী মানুষটির নাম শোনেননি, এমন পড়াশোনা জানা মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্টিফেন হকিং ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মহাকাশতত্ত্ববিদ ডেভিড সিয়ামার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি প্রোগ্রামে যোগ দেন। গ্যালিলিওর জন্মের ঠিক তিনশ বছর পর জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী তখন থেকেই তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে থাকেন। পিএইচডি শেষ করার আগেই মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর জীবন আচমকা থমকে দাঁড়ায়। মোটর নিউরন রোগ বা এমায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস নামক এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন হকিং। এই রোগে পেশি নাড়ানোর জন্য দায়ী নিউরনগুলোর মৃত্যু ঘটতে থাকে এবং শরীরের প্রায় সব অংশ অচল হয়ে যেতে থাকে। বাগদত্তা জেইন ওয়াইল্ড ও সুপারভাইজার সিয়ামার অনুপ্রেরণায় আশার সঞ্চার হয় তাঁর মাঝে। ঠিকমতো কলমটিও ধরতে না পারা এই বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের সাথে তাঁর কালজয়ী ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব প্রকাশ করেন, বর্তমানে যা হকিং রেডিয়েশন নামেও পরিচিত। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ আর্টস এর সম্মানিত ফেলো এবং পলিটিক্যাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ খেতাবে ভূষিত হন। লেখক হিসেবেও হকিং বিস্ময়কর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। স্টিফেন হকিং এর বই সমূহ পাঠক সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাঁর নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে রচিত বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ দিয়ে তিনি ব্রিটিশ সানডে টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় ছিলেন টানা ২৩৭ সপ্তাহ। স্টিফেন হকিং এর রচনা সব ধরনের পাঠকদের কাছে জটিল বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা সহজভাবে জানার পাথেয় হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত এই বিজ্ঞানীকে ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের সম্মাননা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে তিনি এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পাঠকনন্দিত স্টিফেন হকিং এর বই সমগ্র হলো ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’, ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’, ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’, এবং ‘দ্য নেচার অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম’। ২০১৪ সালে ইউনিভার্সাল পিকচার্স ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। এই সিনেমায় স্টিফেন হকিং এর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য এডি রেডমেইন জিতে নেন অস্কার। শারীরিকভাবে ভীষণ রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও হকিং তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সাথে চালিয়ে যান। ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।