শওকত আলী বাংলা কথাসাহিত্যে একজন শক্তিমান ও। বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক বলে স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাহসিকতার। সঙ্গে তিনি তাঁর বক্তব্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। পারেন। ষাটের দশকে বাংলা কথাসাহিত্যের ব্যপ্ত জগতে। প্রবেশ করেই তিনি তার সক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রচলিত সাহিত্যাদর্শের সমান্তরাল ধারায় বিষয়ে যেমন। নিয়ে আসেন অভিনবত্ব, কলাকৌশলে নিয়ে আসেন। বৈচিত্র্যময় টেকনিক, তেমনি ট্রিটমেন্ট ও পদ্ধতিগত ভিন্নতাও নিয়ে আসেন। বাংলা কথাসাহিত্যের প্রবহমান। ধারায় অঙ্গিভূত থেকে, অগ্রজদের সাহিত্যকর্মের নির্যাস। আহরণ করে, সমকালীনদের মধ্যে থেকেও শওকত। আলী নির্মাণ করেছেন আপন শিল্পভূবন। সাতচল্লিশপূর্ব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল, ষাটের দশকের নব্য। ঔপনিবেশিক কাল, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী। বাঙালি জীবন, '৯০ এর গণঅভ্যুত্থান, বিংশ শতাব্দীর । প্রযুক্তিযুগসহ দীর্ঘ পাঁচ দশকের বাঙালি জীবন তার। উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে স্বতন্ত্র মনন, মেজাজে এবং রং। ও রেখায়। এতদপরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় তার বিষয়। নির্বাচনে রয়েছে গতানুগতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়া। তাই দেখি তিনি অত্যন্ত সুক্ষভাবে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেন। এবং নিবিড় আন্তরিকতায়, নির্মোহ দৃষ্টিতে উপন্যাসের। মানব-মানবীকে সৃজন করেন। সময় ও সমাজবাস্তবতার নিরিখে বাঙালি জীবনের প্রদোষকাল থেকে আধুনিককাল পরিসরের যাপিতজীবন, বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই, রাজপ্রশাসনের শােষণপীড়ন, কৃষিজীবী তৃণমূল মানুষের। অধিকার, নাগরিক জীবনের বিকলাঙ্গরূপ এবং গ্রামীণ। জীবনের অভাজনের জীবনমথিত কান্না প্রভৃতি চিত্রিত। হয়েছে তার উপন্যাসে। পল্লীর নিম্নবর্গ নিরন্ন মানুষই শুধু। নয় নাগরিক জীবন, ইতিহাস, আধুনিক প্রযুক্তির। অভিঘাত ঐতিহ্যের কথাও তার শানিত কলমে শিল্পরূপ। লাভ করেছে। সামগ্রিক মানব প্রেমের জীবনের জয়গাঁথা বর্ণনার পাশাপাশি মধ্যবিত্তের দালাল চরিত্রের মুখােশ। উন্মোচন করেছেন দৃঢ় সাহসিকতায়। জীবনের গভীর। থেকে গভীরতর স্তরে প্রবেশ করে জীবনকে তিনি নিরীক্ষা। করেন দক্ষ-বীক্ষণে এবং সামগ্রিক জীবনকে নিয়ে নির্মাণ। করেন তাঁর কথাসাহিত্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্ৰভূমি ।মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে আদর্শ ও আদর্শের স্বপ্নভঙ্গুরতা। নিয়ে তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে থেকে প্রকাশিত হল। মুক্তিযুদ্ধে উপন্যাস উপন্যাস সমগ্র-০১এটি শওকত আলীর রচনার বিশেষ দিক উন্মােচিত করবে।
শওকত আলীর (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ - ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। জন্মস্থান পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ। স্কুলের পড়াশোনা শ্ৰীরামপুর ও রায়গঞ্জে। দেশ-বিভাগের চার বছর পর তাঁর চিকিৎসক পিতা সপরিবারে দিনাজপুর শহরে চলে এলে শওকত আলী সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে দীর্ঘ পাঁচিশ বছর অধ্যাপনা করার পর বর্তমানে তিনি সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। একটি ছোট উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ” (১৯৬৪) তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। এর পর প্রকাশিত হয়েছে। দুটি ছােটগল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। শিশুকিশোরদের জন্যেও তিনি লিখে থাকেন। বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শওকত আলী বাঙলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। এ ছাড়াও তাঁকে ১৯৮৩ সালে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপূস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে রাষ্টিয় পুরস্কার ২১শের পদকে ভূষিত করা হয়। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্ৰহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায়—লুপ্ত ও ঝাপসা ইতিহাসে তাঁর সৃজনশী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।