“শ্রেষ্ঠ গল্প" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় এক উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট নাম বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেবের মতাে সব্যসাচী সাহিত্য-প্রতিভা আর কেউ আসেন নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে পৃথিবীব্যাপ্ত সামূহিক অবক্ষয় ও বিপন্নতার প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর দীপ্র আবির্ভাব। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সাহিত্যকর্মে, বিশেষত ছােটগল্পে, অঙ্কন করেছেন। দ্বন্দ্বপীড়িত মধ্যবিত্ত মানুষের নৈঃসঙ্গের দুর্ভর বেদনা, আত্মদহনের তীক্ষমুখ জ্বালা, বিচ্ছিন্নতার দুর্মর যন্ত্রণা এবং সৌন্দর্য ও ভালােবাসার আত্মমুখী এক স্বপ্নলােক। আত্মজৈবনিক উপাদান ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বুদ্ধদেবের ছােটগল্পভুবন। তাঁর ছােটগল্পে মূলত প্রতিভাসিত হয়েছে আধুনিক মানবচৈতন্যের পীড়িত সত্তার সঙ্কট। বুদ্ধদেবের গল্প, বস্তুত, তাঁর কবি-আত্মার নির্জন শব্দ-স্বাক্ষর। অতীত স্মৃতিমুগ্ধতা, নস্টালজিয়া এবং কৈশাের-প্রথম যৌবনের ঢাকা-জীবন বুদ্ধদেবের গল্পসাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ। বুদ্ধদেবের প্রেমের গল্পগুলাে তাঁর ছােটগাল্পির প্রতিভার বিশিষ্টতার পরিচয়বাহী। চিত্ত আর সত্তাকে চঞ্চল করে তােলে বুদ্ধদেবের প্রেমের গল্প। বুদ্ধদেবের ছােটগল্পে যে-সব নায়কের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাদের সকলের অবয়বেই বিম্বিত হয় ব্যক্তি-বুদ্ধদেবের ছবি, তাদের কণ্ঠে শােনা যায় বুদ্ধদেবের আত্ম-অনুভূতির স্বরগ্রাম। প্রধানত নাগরিক মধ্যবিত্ত-জীবনের শিল্পভাষ্যকার হলেও, বুদ্ধদেবের ছােটগল্পে কখনাে কখনাে নাগরিক নিম্নবর্গের মানুষও শিল্পিত হয়েছে। অসামান্য ব্যঞ্জনায়। তাঁর গল্পের ভাষা কবিতাস্পর্শী, আবেগঋদ্ধ ও সঙ্গীতমুখর। অন্তরাশ্রয়ী গতিময়তা তাঁর ছােটগাল্পিক ভাষারীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্তমান গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসুর চব্বিশটি গল্প সঙ্কলিত হলাে। আমাদের বিশ্বাস এই সঙ্কলন বুদ্ধদেব বসুর ছােটগাল্পিক সত্তাকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।