বাংলা নবজাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে গদ্যের সূচনা হলে কথাসাহিত্য আকরপ্রাপ্ত হয়। সমাজ অনুসৃত রীতিনীতিতে আঘাত পড়ে। প্রচলিত নীতির বাইরে প্রগতিশীলতার ধারণা বিচ্ছুরিত হয়। ফলশ্রুতিতে হুতোম প্যাঁচার নক্শা, নবাবাবু বিলাস লিখিত হয়। সমাজের অসঙ্গতি, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধরূপে এসব নকশাগুলো প্রণীত হয়। খুব গভীরভাবে দেখলে প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) প্রথম উপন্যাসের ধারণা- বীজপ্রাপ্ত হলো। প্রসঙ্গত, সমসাময়িক সময়ে নকশাধর্মী নাটক, প্রহসনও লেখা চলে। কার্যত, পরিবর্তমান সমাজের তাগিদেই নকশার ধারণা পেরিয়ে উপন্যাসের কাঠামো স্ফটিকস্বচ্ছ রূপ পায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম বাংলা শিল্পিত উপন্যাসের স্রষ্টা। উপন্যাসের জন্য যে কাহিনীগদ্য দরকার সেটি নির্মাণে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এজন্য সমাজের অঙ্গীকার এবং অদম্য সাহসও অর্জন করেন বঙ্কিমচন্দ্র। নিজ ধর্মের সংস্কার বা রক্ষণশীলতা যতোই থাক বা প্রচলিত সমাজনীতি যত তাঁকে বাধাপ্রাপ্ত করুক বস্তুত শিল্পক্ষুধার কাছেই তিনি পরাজিত হয়েছেন। যে কারণে অনেক রকমের প্রতিরোধ ও প্রতিপক্ষ থাকা সত্ত্বেও তিনি পরাস্ত নন, ধরাশায়ী নন। যদিও তিনি কোনোকিছুতেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। পুনর্বার তিনি আচ্ছন্ন হয়েছেন ধর্মবুদ্ধি দ্বারা, লেখাগুলো পরিব্যপ্ত হয়েছে বিশেষ ধর্ম-জাতি সম্প্রদায়ের বুদ্ধি দ্বারা। এক রকমের উস্কানি যে তাতে নেই তাও বলা যাবে না। এসব প্রতিরোধ ও প্রগতির মুখে বঙ্কিম বড় শিল্পী, বিরাট শিল্পপ্রতিভা। তাঁর উপন্যাসেই জীবনকাহিনী সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি পরিপ্রেক্ষিতরূপে পরিগণিত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিচরিত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়। ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক-সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র রূপজ মোহকে উপন্যাসের
(নভেম্বর ১৩, ১৮৪৭ - ১৯১২) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক যিনি ঊনবিংশ শতাব্দাীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্যের ঊণ্মেষকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বিষাদ সিন্ধু নামক ঐতিহাসিক রচনার জন্য সপুরিচিত ও সাধারণ্যে জনপ্রিয়। তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ফরিদপুরের পদমদীতে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যরস সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস "বিষাদসিন্ধু" তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। মীর মশাররফ হোসেন খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে অতিবাহিত করেন। তবে তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর বলে দাবী করেন। তিনি মীর মোয়াজ্জেম হোসেন (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আঠার বছরে বয়সে তারঁ পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয়। ১৯১২ সালে দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজার থাকাকালেই মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়।