ফ্ল্যাপে লিখা কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। কখনও নিজের কথায় আবার কখনও তাঁর কাছের মানুষের স্মৃতিচারণায় কবির ভ্রমণকাহিনী বিভিন্ন ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ এ ধরনেরই একটি রচনা। পর্যটন কেন্দ্র দার্জিলিংয়ের মংপু কবিগুরুর অবকাশ যাপনের অন্যতম পছন্দের একটি জায়গা। বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসেছেন। জীবনের প্রায় শেষ সময়েও ভ্রমণের জন্য তিনি মংপুতেই যেতে চেয়েছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে কারি পরিচয় দীর্ঘদিনের। তাঁর জীবনের প্রথম কবিতার বইয়ে কবি সানন্দে ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন মংপুতে কবির অবকাশ যাপনের দিনগুলিতে মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন তাঁর অন্যতম কাছের মানুষ। বলতে গেলে মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যেই মংপুতে কেটেছিল কবির দীর্ঘ অবকাশকাল। কবির সাহচর্যের সুখানুভূতির সেই দিনগুলোর কথামালা, মৈত্রেয়ী দেবী এ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তাঁর অসাধারণ রচনাশৈলীতে মংপুতে কবির অবস্থানের ঘটনাগুলি হয়েছে সরস ও প্রাণবন্ত। এই বইটি পড়ে পাঠক অন্য এক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হবেন-যিনি শুধু কবি নন, অনন্য এক মানুষ।
নিবেদন ১৯৩৮ এর ২১ শে মে পূজনীয় গুরুদেব প্রথমবার কালিমপং থেকে মংপু এসছিলেন। ৯ জুন পর্যন্ত এখানে কাটিয়ে আবার কালিমপং ফিরে যান। দ্বিতয়িবার ১৯৩৯ এর ১৪ মে পুরী থেকে মংপু এসে গ্রীষ্মাবকাশটি কাটিয়ে ১৭ই জুন নাগাদ কলকাতায় নেমে গেলেন। ঐ বৎসরই শরৎকালে ১২ সেপ্টেম্বর মংপুতে এসেছিলেন এবং দুই মাসের কিছু অধিককাল থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতা নেমে যান। চতুর্থবার ১৯৪০ সালের ২১শে এপ্রিল এখানে আসেন, ২৫ শে বৈশাখের উৎসব এখানেই সম্পন্ন হয়, তারপর কালিমপং যান। সেই বৎসর শরৎকালে আবার আসবার কথা ছিল, সেজন্য তাঁর জিনিসপত্র সবই রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত আর তাঁর আসা হয়নি। ১৯৪০ এর সেপ্টেম্বরে অসুস্থ শরীরে, মংপুর মত ডাক্তারহীন গণ্ডগ্রামে আসা উচিত হবে না বলে প্রথম কালিমপং এলেন। কথা ছিল একটু সুস্থ হলে মংপু আসবেন। কিন্তু তা আর হলো না। হঠাৎ দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ২৮ মে সেপ্টেম্বর অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো।
আমার এই রচনার উপাদান ছিন্ন ছিন্ন পৃষ্ঠায় ইতস্ততভাবে লেখা ছিল, প্রত্যেক দিনের তারিখও দেওয়া ছিল না। সেজন্য বইতে উপযুক্তভাবে তারিখ দিতে পারিনি। ইতিহাস রক্ষা বা সাহিত্য সৃষ্টি কোনোটাই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। অবসর পেলেই আমি তাঁর মুখের কথাগুলি লিখে রাখতাম এবং কাজের মধ্যে মনে মনে আবৃত্তি করে মনে রাখতাম , সে কেবল আমার নিজের আনন্দের জন্যই।আর একটি কথা এখানে জানানো কর্তব্য যে, আমার এই রচনা যদিও তিনি বার বার দেখতে চেয়েছেন, রহস্য করেছেন, কিন্তু কখনো দেখেনটি। যে কথাগুলি নিতান্ত ঘরোয়াভাবে বলেছেন, যে কথা ছাপাতে গেলে তিনি হয়হত অন্যভাবে বলতেন, তাও এখানে থাকতে পারে। ঘরের কথা হাটের মাঝখানে এলে, অপরাদ ঘটা অসম্ভব নয়। তবু তাঁর মুখের কথায় সমস্ত দেশের অধিকার স্মরণ করে এই ডায়েরি প্রকাশ করলাম। মৈত্রেয়ী দেবী
তিনি ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার বাবার কর্মস্থল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও মায়ের নাম হিমানী মাধুরী রায়। তার বাবা ছিলেন একজন দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক। তার শৈশব কাটে বাবার বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈল ঝারার গৈলা গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ন হন্যতে তাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্য ছাড়াও সমাজসেবায় অনন্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৩৪ সালে তিনি ড. মনোমোহন সেনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মনোমোহন সেন ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। তার সাহিত্যজীবন শুরু ষোল বছর বয়সে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ উদিত ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ চিত্তছায়া। ১৯৪২ সালে রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাঠানো দিনগুলোর স্মৃতি ও তার সাথে আলাপচারিতা নিয়ে লিখেন স্মৃতিকথা মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বুলগেরিয়া, হাংগেরী ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যান৷ সোভিয়েট ইউনিয়ন তাঁকে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পদকে ভূষিত করে। মৈত্রেয়ী দেবী সোভিয়েট ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকাতে রবীন্দ্রনাথের ওপরে ও শান্তির সমস্যা বিষয়ক বহু ভাষণ দেন। তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি অনাথ শিশুদের জন্য 'খেলাঘর' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংস্থার দেখাশুনা করেন।তিনি ১৯৮৯ সালের ২৯ জানুয়ারী ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।