"উৎসারিত আলো" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: তােয়া, দুখন, মাংরা, বুধনি, সুখী। ওরা আদিবাসী৷ ছােটনাগপুরের এক রুখুসুখু গ্রামে ওদের বসতি। সে গ্রাম জলবিহীন, নদী নেই। বৃষ্টি হয় খুব সামান্য। মাটিও তেমন উর্বর নয়। এতােয়াদের জীবন চলে অতি কষ্টে, ভয়ংকর দারিদ্রে। এক গ্রীষ্মের দাবদাহে স্থানীয় মহাজন লালমােহন তেলি তাদের স্বপ্ন দেখাল এক সােনার দেশের যেখানে জল আর খাবার অফুরন্ত। দয়ালু ইংরেজ রাজা তাদের সেখানে নিয়ে যেতে চায়। একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার আশায় যেতে রাজি হল সেই গ্রামের মানুষ। আসলে জোয়ান নারীপুরুষ তাদের শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ওয়াগন ভর্তি হয়ে চালান হয়ে গেল ডুয়ার্সে। চা বাগানের কুলির কাজে। সেখানে ধর্মান্তরিত হয়ে বুধনিরা হয়ে গেল যিশুবাবার সেবক। গাঁওবুডাের বউ সুখীর নাম হয়ে গেল সুসান। প্ল্যান্টার হেগসাহেবের রক্ষিতা হতে হল তাকে। বাঘ, সাপ আর চাবুকের সামনে দুখনদের ক্রীতদাসের জীবন। সেখানে পদে পদে অসুখ, মৃত্যু আর তারই মধ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এরই মধ্যে একটি অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল সুখী। শ্বেতাঙ্গ এই সন্তানটির পিতা কে? চা বাগানের চার্চের ফাদার পিতৃপরিচয়হীন এই শিশুটির মধ্যে আবিষ্কার করলেন মানবাত্মা যিশুকে। কিন্তু অন্য চা-মজুরদের জীবন? তা কি স্তব্ধ হয়ে গেল? চায়ের পাতার শিরায় শিরায় তারা পেল কোন জীবনের ঠিকানা?
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।