"মৌষলকাল" সত্তরের নকশাল রাজনীতিতে অনিমেষের জড়িয়ে পড়া এবং পুলিশি অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কাহিনি তুমুল এক ইতিহাসের কথাই বলে। সমরেশ মজুমদার এই চরিত্রটিকে নিয়ে তিনটি বিখ্যাত উপন্যাস রচনা করেছেন, যা ধারণ করে আছে পশ্চিমবঙ্গের অনতি-অতীতকালের রাজনৈতিক-সামাজিক সময় প্রবাহ।অনিমেষের বান্ধবী হিসেবে সময়ের সঙ্গে যুঝেছে মাধবীলতা। সময়ের ফসল হিসেবে এসেছে তাদের সন্তান অর্ক। বড় হয়ে অর্কও দুঃখী মানুষদের নিয়ে সাধ্যমতো স্বপ্নপ্রয়াসে জড়িয়ে পড়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে যথারীতি। সর্বত্রই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল হিংস্র থাবা নিয়ে তৈরী। পঁচিশ বছরেরও বেশি পার করে সমরেশ মজুমদার লিখেছেন অনিমেষ-মাধবীলতা-অর্কের নতুন কাহিনি ‘মৌষালকাল'। এই উপন্যাসের আধার পশ্চিমবঙ্গের এক উত্তাল সময়। রাজনৈতিক পালা বদলের সেই ইতিহাসের নানান বাঁকে উপস্থিত মাঝবয়সি অর্ক। স্বভাব-প্রতিবাদে, আবেগে, অস্পষ্ট ভালবাসায় অর্ক যেন এক অবাধ স্বর। মৌষল পর্বের পারস্পারিক অবিশ্বাসের দিনকালেও পৌঢ় অনিমেষ-মাধবীলতা ঝলসে ওঠে আর-একবার।কেউ বিপ্লব-বিশ্বাসে, কেউ বা জীবন-বিশ্বাসে অটুট।
"কালপুরুষ" ফ্ল্যাপে লিখা কথা সত্তর দশকের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার শেষ পর্বে কালবেলার নায়ক অনিমেষ আশা করেছিল তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নিশানটি শক্ত হাতে বহর করে নিয়ে চলবে।ভ কিন্তু সমকালীন অন্তঃসারহীন কটিল রাজনীতি এবং পঙ্কিল সমাজব্যবস্থার অর্ককে করে তুলেছিল অন্ধকার অসামাজিক রাজত্বের প্রতিনিধি। কিন্তু যেহেতু তার রক্তের মধ্যে ছিল অনিমেষের সুস্থ আদর্শবাদ এবং তার মা মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সংমিশ্রিত উপাদান, সেই হেতু তার বোধোদয় ঘটতে বিলম্ব হয়নি। এক ভিন্ন মানসিকতায় সে আহ্বান শুনেছিল চিরকালীন মানবতার।ভ একদিকে সুবিধাবাদী সমাজব্যবস্থার যূপকোষ্ঠে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত কিছু মানুষকে একত্র করে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল নতুন ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তাদের সামনে তুলে ধরেছিল আগামী পৃথিবীর সুন্দরতম এক মানচিত্র। কিন্তু ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল ও সমাজ অর্ককে অর্গলবদ্ধ করে সেই পবিত্র পৃথিবীর স্বপ্নটি ভেঙে চুরমার করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু অর্ক- যার অপর নাম সূর্য- তার আবির্ভাবকে কি চিরকালের মতো রুদ্ধ করে রাখা যায়? কালপুরুষ উপন্যাসের সমাপ্তিতে সে মানবতার আহ্বানের প্রতিধ্বনি স্পষ্টতর।
"কালবেলা" ফ্ল্যাপে লেখা কথা অনিশেষ যখন প্রথম কোলকাতায় পা রেখেছিল তখন রাস্তায় ট্রাম জ্বলছে, গুলি চলছে। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা এই তরুণটি সেদিন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। তারপর আর পাঁচটা মানুষের মত গা ভাসিয়ে ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ তার জীবনের মোড় পাল্টালো। ছাত্র রাজনীতি তাকে নিয়ে গেল জটিল আবর্তে। এই দেশে আর দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দুর্বার বাসনায় বিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির পতাকার নিচে গিয়ে দাঁড়াল । কিন্তু মনুষ্যত্ব এবং মানবিক মূল্যবাধ তাকে সরিয়ে নিয়ে এল উগ্র রাজনীতিতে। সত্তরের সেই আগুনের ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে দপ্ধ করে সে দেখল, দাহ্যবস্তুর কোন সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। পুলিশের নির্মম অত্যাচারে সে যখন বিকলাঙ্গ তখন বিপ্লবের শরিকরা হয় নিঃশেষ নয় গুছিয়ে নিয়েছে আখের। অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল মাধবীলতাকে। মাধবীলতা কোন রাজনীতি করেনি কখনো, শুধু তাকে ভালবাসে আলোকেস্তম্ভের মত একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায় না। বাংলাদেশের এই মেয়ে যে কিনা শুধু ধুপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে। দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আাবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় এই দুটি চরিত্র লক্ষ পাঠকের ভালবাসা পেয়েছিল। সুস্থ উপন্যাসের সেইখানেই সার্থকতা।
"উত্তরাধিকার" বইটিতে লেখা ফ্ল্যাপের কথাঃ এই উপন্যাসের কাহিনীর শুরু উত্তরবঙ্গের একটি চা-বাগানের পটভুমিকায়। ১৯৪৭ সালের পনেরই আগস্টে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদ্য়াপনের সময় অনিমেষ নামে একটি কিশোর প্রথম শুনেছিল ‘বন্দেমাতরম্’ শব্দটি। শব্দটির অর্থ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পারলেও তার ধ্বনি-ব্যঞ্জনা তার মনকে নাড়া দিল। এই শব্দটির ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আর তার মূল্য বুঝতে না বুঝতে সেই কিশোর হয়ে উঠল সদ্য তরুণ। তারপর সেই তরুণ উচ্চশিক্ষার জন্য এল কলকাতায়। সেইদিন সারা শহরে আগুন জ্বলছে- এক আন্দোলনের ভয়ঙ্কর পরিবেশ। নিজের সম্পর্কে, দেশের সম্পর্কে পুরনো বিশ্বাস, শ্রদ্ধা-ভালবাসার সঙ্গে নতুন করে তার মুখোমুখি পরিচয় শুরু হল। এই কাহিনী সেদিনকার সেই কিশোর তরুণ অনিমেযের আত্ম-অনুসন্ধানের কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান কথাশিল্পীদের মধ্যে সমরেশ মজুমদার অগ্রগণ্য। তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈল্পীদের জন্য একতম বেললেও অন্যায় হবে না। ইতিপূর্বে তাঁর অন্য উপন্যাসে পাঠকেরা সে পরিচয় পেয়েছেন। ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে তিনি এবার নিজেকেও অতিক্রম করে গেছেন। এই ধরনের ঘরোয়া গল্পে অনুপম প্রসাদ-গুণে ভরা মনোমুগ্ধকর রচনার মধ্যে একালের তরুণের জীবন-জিজ্ঞাসাকে মূর্ত করে তোলার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে অতি বিরল। ১৯৮৪ সালে অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে নায়ক অনিমেষের মধ্যজীবন-পর্বের কাহিনী, যে জীবনের উন্মেষ হল এই ‘উত্তরাধিকার’ গ্রন্থে।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।