১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন। পলাশির শোচনীয় ব্যর্থতার পর সারা দেশ জুড়ে শুরু হল অত্যাচার। শুধু অত্যাচার। সীমাহীন অত্যাচার। ধর্ম, মান, সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, নারীর ইজ্জত, মানুষের জীবনধারণের মৌলিক অধিকার, সামান্যতম অর্থনৈতিক সম্বল—সব কেড়ে নিল বিদেশি বেনিয়ার দল। পদে পদে শুধু অনাচার, লাঞ্ছনা, ঘৃণা আর অপমান। প্রতিবাদে মুখর হল দেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক ঘটে গেল বিক্ষিপ্তভাবে নানা বিদ্ৰোহ । নগ্ন কৃপাণ হাতে চাষি, মজুর, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যোগ দিল এই সব বিদ্রোহে। এল ১৮৫৭ সাল। সারা দেশ সেদিন প্রতিবাদে মুখর। রাজা রাজ্য হারিয়েছেন। জমিদার হারিয়েছেন জমি। রাজার সেনাদল বেকার। বেকার রাজকর্মচারীরা। বেকার চাষি, মজুর, জমিদার—সবাই। বিক্ষোভ— শুধু বিক্ষোভ। দেশ জুড়ে শুধু প্রতিবাদ। বুভুক্ষু মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিক্ষোভ ইংরেজ কোম্পানির সেনাবাহিনীতেও। তাদের বেতন কম—কাজ বেশি। পদে পদে শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা। তারপর এল এনফিল্ড রাইফেলের নতুন টোটা। দাঁতে কেটে তা বন্দুকে ভরতে হবে। এ নাকি হিন্দু-মুসলমান সিপাইদের জাত মারার নতুন চক্রান্ত। প্রতিবাদ— প্রতিবাদ উঠল সেনা ছাউনিতে। শহরে শহরে প্রচারিত হল ইস্তাহর : “স্বদেশবাসিগণ,স্বধর্মে অনুরাগিগণ, ওঠো, ফিরিঙ্গিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সবাই মিলে উঠে দাঁড়াও। ওরা ন্যায়কে পদদলিত করেছে, আমাদের স্বাধীনতা হরণ করেছে, ওরা স্থির করেছে আমাদের জাতিকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেবে। এ ফিরিঙ্গিদের অসহনীয় অত্যাচার থেকে হিন্দুস্থানকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রক্তাক্ত সংগ্রাম। এ হল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ। স্বর্গের দ্বার শহীদদের জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত। কিন্তু যে-সব ভীরু, যে সব দেশদ্রোহী এই জাতীয় কর্তব্য থেকে দূরে সরে যাবে, নরকের আগুন সে-সব দুর্ভাগাদের পুড়িয়ে ফেলবে। স্বদেশবাসিগণ, এ দুয়ের মধ্যে কোনটা তোমরা চাও? বেছে নাও।—এখনই বেছে নিতে হবে।” ফৌজি ব্যারাক থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে হাতে গড়া চাপাটি। কখনও কখনও সঙ্গে রয়েছে লাল পদ্মের পাপড়ি। সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির-দরবেশ গাঁয়ে গাঁয়ে প্রচার চালাচ্ছেঃ ‘সতেরোশও সত্তাবান কে বাদ আঠারোশও সত্তাবান্ আ গিয়া। অব তো অংরেজ রাজ খতম্ হোনে চলা।’ ২৩শে জুন—১৮৫৭ সাল। পলাশির যুদ্ধের ঠিক এক'শ বছর পরে সারা ভারতের সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করবে। স্বৈরাচারী ইংরেজকে দূর করে দেবে দেশ থেকে। নেতা বাহাদুর শাহ—মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ। বিদ্রোহ শুরু হবে ২৩শে জুন— ১৮৫৭ সাল। কিন্তু তার আগেই ঘনিয়ে এল বিদ্রোহের কাল।